অতি স্বাধীনতা ভালো না : ড. মিজান
বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ভালো কিন্তু অতি স্বাধীনতা ভালো না বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। বৃহস্পতিবার দুপুরে বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস-২০১৫ উপলক্ষে এক সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
ড. মিজান বলেন, ‘মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করতে দেয়া যাবে না। আমাদের স্বাধীনতার জায়গাটিকে আরো প্রশস্ত রাখতে হবে। এবং আমাদের স্বাধীনতাকে কোনোভাবে সংকুচিত হওয়ার অবস্থা যেন সৃষ্টি না হয় সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। আর এর জন্য রাষ্ট্রের যে দায়িত্ব রয়েছে, সেটি রাষ্ট্রকে গুরুত্বের সাথে পালন করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা কিছু দিনের জন্য বন্ধ করা যায়। কিন্তু এটকে মূলে বন্ধ করা যায় না। সেটি আমাদের রাষ্ট্রকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে। আমার স্বাধীনতা- সেটি আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা হোক, আমার চলাফেরার স্বাধীনতা হোক, তা কখনো হরণ করা যাবে না। কারণ এটি আমার মর্যাদার সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। কখনো যদি আমার স্বাধীনতা হরণ করা হয় তাহলে আমার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হবে। যদি মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হয় তাহলে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত অবস্থায় পৌঁছাতে পারবে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘কিছু কিছু সংগঠন এবং ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমাদের দেশের মিডিয়াগুলোর ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। তার উদাহরণ হচ্ছে ব্লগার। আজকে বাংলাদেশে ব্লগার বলতে একটা নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা হয়। এ ধারণার পিছনে কাদের অবদান বেশি, কেন ব্লগারদের সম্পর্কে এতো নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা হচ্ছে। আমরা কেন আমাদের মূল জায়গা থেকে এতো বিচ্যূত হয়ে গেছি। তার কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।’
মানবাধিকার কমিশনের চেয়াম্যান বলেন, ‘আজ আমাদের দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হচ্ছে নিরাপত্তা। মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ যদি না থাকে তাহলে রাষ্ট্রতো কোনো সময় নিরাপদ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কেমন। কিভাবে আমরা আমাদের দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি। এ বিষয়টি আমরা অনেক সময় ভুলে যাই। এমনকি রাষ্ট্রকেও আমাদের অনেক সময় স্মরণ করে দিতে হয় যে- ‘রাষ্ট্র তখনই তুমি শক্তিশালী হবে, যখন জনগণ তোমাকে ভালোবাসবে। জনগণের আস্থা অর্জন করতে শিখো। রাষ্ট্র এবং জনগণের মধ্যে কোনো প্রকার দূরত্ব থাকতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘যেভাবে একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের রাষ্ট্র এবং জনগণ আমরা একই হয়ে গিয়েছিলাম। সে জায়গাটা কমিয়ে এনে এবং সে দূরত্বটা তৈরি করে আমাদের রাষ্ট্রকে কিভাবে মানববান্ধব, জনবান্ধব করতে হবে সেটি বোধ হয় আমাদের অবশ্যই চিন্তা করার দরকার। এটা যদি নিশ্চিত করতে পারতাম তাহলে আমাদের আর এখানে দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের কথা বলতে হতো না। আমরা মানবাধিকারের জন্য বিশ্বের মধ্যে মডেল হয়ে থাকতে পারতাম।’
সেমিনারে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, ‘আজকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি যে চিন্তার বিষয় সেটি হচ্ছে আমরা কারো ধর্মীয় অনভূতিতে কি আমরা আঘাত করছি কিনা? মুসলিম প্রধান দেশে হওয়ায় সেটি আমাদের আরো বেশি গুরুত্বের সাথে দেখতে হচ্ছে। আজকে সারা পৃথিবীর যে রাজনীতি চলছে সেটিকে আরো ভীষণভাবে উস্কে দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের জন্মই হয়েছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। সেটা যদি আমরা মনে করতে পারি যে ১৯৫২ সালে উর্দু ভাষা আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে না। যার চূড়ান্ত হয়েছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ দিয়ে। সে সময় আমরা বলছি- আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ, আমরা শুধু ভৌগলিক একটা ভূখণ্ড চাইনি। আমরা চেয়েছি এমন একটা দেশ যেটি আমাদের নিজের, এখানে গণতন্ত্র থাকবে, এখানে জাতিগুলোর নিজস্ব পরিচয় থাকবে, তারা মর্যাদা নিয়ে বাঁচবে, দেশটি ধর্মনিরপেক্ষ থাকবে একই সাথে সম্পদের একটা সুষম বণ্টন থাকতে হবে। যেকোনো মানুষ বঞ্চনার সাথে বাস না করে। কারণ অধিকারের সাথে মানবাধিকারের সাথে জড়িত। কিন্তু আমরা এখন তা দেখছি না। আজকে আমাদের সংবিধানে পর্যন্ত এ দিকটি নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা আমাদের সংবিধানে একদিকে বলছি আমাদের রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। অন্যদিকে বলছি আমাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। অর্থাৎ আমরা যা হয়ে জন্মগ্রহণ করেছি সেভাবে আমরা রূপান্তরিত হতে পারছি না। উল্টো পথে রূপান্তরিত হচ্ছি।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (জামাকন) এ সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে আরো বক্তব্য রাখেন- সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরুদ্দিন বাচ্চু, অধ্যাপক গিতী আরা চৌধুরী, খালেদ মাহিউদ্দিন প্রমুখ।
সেমিনারে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মতন্ত্র ও মানবাধিকার : এ সময়ের বাংলাদেশে’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক রোকেয়া চৌধুরী।
এমএইচ/এসএইচএস/আরআইপি