আফগানিস্তানে তালেবানের পুনরুত্থানে ‘সবচেয়ে বেশি’ দুশ্চিন্তায় ভারত
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য পুরোপুরি প্রত্যাহারের সময়সীমা যত এগিয়ে আসছে, ততই ঝড়ের গতিতে একের পর এক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে তালেবান। দেশটির কমপক্ষে ৭০ শতাংশ এলাকা এখন তাদের দখলে বলে দাবি করছে সশস্ত্র সংগঠনটি। এমনকি রাজধানী কাবুলের ওপরও নিঃশ্বাস ফেলছে তারা। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর যে বিশ্লেষণী প্রতিবেদন সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়, তাতে বলা হয়েছে, মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ছয় মাসের মধ্যেই কাবুলের বর্তমান সরকারের পতন হতে পারে। আর তা সত্যি হলে ২০ বছর পর তালেবানই যে আবার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তালেবানের এমন পুনরুত্থানে বিশ্বের অনেক দেশই চিন্তায় পড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা যার মাথায়, সে হচ্ছে ভারত।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানের কান্দাহার শহরের ভারতীয় কনস্যুলেটের কূটনীতিকদের গত শনিবার যেভাবে রাতারাতি দিল্লিতে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে, তাতে ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, আফগান ভূমিতে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভারত কতটা উদ্বিগ্ন। হেরাত, জালালাবাদ এবং মাজার-ই-শরিফের ভারতীয় কনস্যুলেটগুলো এখনো খোলা থাকলেও সেগুলোর কাজকর্ম কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
কয়েক ডজন কূটনীতিককে দিল্লিতে ফিরিয়ে নেয়ার এই সিদ্ধান্তের মাত্র কয়েকদিন আগে আফগানিস্তানে ভারতের সহযোগিতায় তৈরি একটি বাঁধে তালেবানের হামলায় কমপক্ষে ১০ জন নিরাপত্তা রক্ষী মারা যায়। হেরাত প্রদেশের ওই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আফগানিস্তানে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রকল্প, যেখানে তারা অন্তত ৩০ কোটি মার্কিন ডলার খরচ করেছে। নতুন করে তৈরির পর সালমা ড্যাম নামে পরিচিত ওই বাঁধের নামকরণ করা হয় ভারত-আফগানিস্তান মৈত্রী বাঁধ, যেটির উদ্বোধন করতে ২০১৬ সালে আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
আফগানিস্তান-ভারত সম্পর্কের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত ওই বাঁধে গত সপ্তাহে হামলার ঘটনায় তালেবানের উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতের মধ্যে শঙ্কা ও সন্দেহ বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বড় চিন্তা ভারতের
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সঞ্জয় ভরদোয়াজ বলেন, অনেক দেশই আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। কিন্তু অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে আফগানিস্তানে ভারতের স্বার্থ এখন সবচেয়ে বেশি। সেখানে তালেবান আবার ক্ষমতায় গেলে ভারতেরই বেশি ক্ষতি হবে।
হেরাতে আফগানিস্তান-ভারত মৈত্রী বাঁধ
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ভারতের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য আফগানিস্তানের গুরুত্ব অপরিসীম। এ নিয়ে তারা এখন জটিল সংকটে পড়েছে।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযানে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর যে দেশটি আফগানিস্তানে প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে সবচেয়ে বেশি তৎপর হয়েছিল, সেটি ভারত। আফগানিস্তানে গত দুই দশকে চার শতাধিক সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং বড় কিছু অবকাঠামো প্রকল্পে ৩০০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে ভারত। আফগানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক উন্নয়নে ডজন ডজন প্রকল্প ছাড়াও দিলারাম-জারাঞ্জ মহাসড়ক নামে ২১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক তৈরি করে দিয়েছে ভারত। কাবুলে নতুন আফগান পার্লামেন্ট ভবনও তাদের বানানো।
তালেবানের পুনরুত্থানের মধ্যে চলমান শত শত প্রকল্পের এখন কী হবে? যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসব বিনিয়োগ করেছিল ভারত, তা কি পানিতে যাবে? ভারতীয় নীতি-নির্ধারকরা এখন সেই চিন্তায় অস্থির।
২০০৮ সালে কাবুলে বোমা হামলায় বিধ্বস্ত ভারতীয় দূতাবাস। এর পেছনে তালেবানের হাত ছিল বলে ধারণা করা হয়।
আফগানিস্তানকে কেন দরকার ভারতের?
ড. ভরদোয়াজের মতে, শুধু ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের জন্যই নয়, আরও অনেক কারণে ভারতের কাছে আফগানিস্তানের গুরুত্ব রয়েছে। তিনি বলেন, বৃহত্তর আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অভিলাষ, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের খাতিরে ভারতের জন্য আফগানিস্তান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ।
মধ্য এশিয়ার বাজারে ঢোকার জন্য ভারতীয়দের কাছে আফগানিস্তান খুবই জরুরি। আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে ইরান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে দুটি পাইপলাইন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। তবে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ এসবের চেয়েও বেশি।
ড. ভরদোয়াজ বলেন, কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে এবং লাদাখ নিয়ে চীনের সাথে বিপজ্জনক দ্বন্দ্ব রয়েছে ভারতের। এখন আফগানিস্তানও শত্রু রাষ্ট্রে পরিণত হলে তা ভারতের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হবে।
কেএএ/এমএস