অাজও চালু হয়নি বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র


প্রকাশিত: ১০:২২ পিএম, ০৮ ডিসেম্বর ২০১৫

বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্মভূমি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দে গড়ে ওঠা স্মৃতি কেন্দ্রটি আজও চালু হয়নি। ২০০১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রের উদ্বোধন করলেও নানা জটিলতায় আটকে আছে এর কার্যক্রম।

নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বেতন-বোনাস না পেয়ে মানবেতর জীবন পাড়ি দিচ্ছেন। আদালতের দেয়া রায়ের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও স্থায়ীকরণ হয়নি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাকরি, চালু হয়নি কেন্দ্রটি। এছাড়াও বেগম রোকেয়ার জন্মভূমিতে গড়ে ওঠা হস্ত ও কুটির শিল্প কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। স্থানীয় মানুষের দাবি ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একীভূত করে সরকারিভাবে পরিচালনা করার। কিন্তু সে বিষয়েও কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়ার জন্ম ও প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে ১৯৭৪ সাল থেকে পায়রাবন্দবাসী রোকেয়াকে স্মরণ করে রোকেয়া দিবস পালন করে আসছেন। সরকারিভাবে ১৯৯৪ সাল থেকে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে বেশ ঘটা করেই দিবসটি পালন করা হয়। সেইসঙ্গে পায়রাবন্দে ৯-১১ ডিসেম্বর রোকেয়া মেলা বসে।

সারা বছরে মাত্র ওই তিনটি দিন বেশ ঘটা করেই বেগম রোকেয়াকে স্মরণ করা হলেও স্মৃতি কেন্দ্রটি চালু না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন দর্শণার্থীসহ পায়রাবন্দবাসী। অবিলম্বে সকল জটিলতা নিরসন করে স্মৃতি কেন্দ্রটি চালু করাসহ চাকরি স্থায়ীকরণের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নারী জাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়ার চিন্তা চেতনাকে জাগ্রত করতে ১৯৯৭ সালের ২৮ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রের ভিত্তি প্রস্তরের উদ্বোধন করেন। প্রায় সোয়া তিন একর জমিতে পৌনে চার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় স্মৃতি কেন্দ্রের। যা ২০০১ সালের ১ জুলাই উদ্বোধন করার পর রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় উপ-পরিচালকসহ ১৩ জন কর্মকর্তা কর্মচারীকে নিয়োগ প্রদান করা হয়। মাত্র দুই বছর চলতে না চলতেই তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বন্ধ হয়ে যায় স্মৃতিকেন্দ্রটি। ভেস্তে যায় রোকেয়ার জীবন কর্ম সম্পর্কে গবেষণা, তার গ্রন্থাবলীর অনুবাদ, সংস্কৃতি চর্চা। নিয়োগকৃত কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতা না পেয়ে শুরু হয় মানবেতর জীবন যাপন।

এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া স্মৃতিকেন্দ্রে শুরু হয় বিকেএমইর পোশাক শ্রমিক তৈরির প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। ২০০৮ সালে পোশাক শ্রমিক তৈরির প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন তৎকালীন সেনা প্রধান মঈন-উ-আহমেদ। পরে মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার স্মৃতি রক্ষার্থে গড়ে তোলা স্মৃতিকেন্দ্রের মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য ব্যাহত করে সেখানে বিকেএমইএ এর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ এবং উচ্ছেদ করার জন্য হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ ২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে একটি রিট করেন। এরই প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট স্মৃতিকেন্দ্রের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং বিকেএমইর কারখানা বন্ধের আদেশ দিলে মিঠাপুকুর উপজেলা প্রশাসন ওই বছরের ১ মে বিকেএমইএর কারখানা উচ্ছেদ করেন।

পরবর্তীতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্মৃতিকেন্দ্রটি নিয়ে টানাটানি শুরু হলে একদিকে স্মৃতিকেন্দ্রের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় অন্যদিকে মানবেতর সময় পার করতে থাকেন নিয়োগকৃত উপ-পরিচালকসহ অন্যরা। এক পর্যায়ে উপ-পরিচালক আব্দুল্যা আল ফারুক উচ্চ আদালতে একটি রিট করেন। এর ফলশ্রুতিতে আদালত চলতি বছরের ১৭ মে উপ-পরিচালকসহ ছয়জনের চাকরি রাজস্বখাতে নেয়ার পাশাপাশি স্মৃতিকেন্দ্রটি চালুর নির্দেশ দেন সংস্কৃতিকবিষষক মন্ত্রণালয়কে। এদিকে, রায়ের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও বাস্তবায়ন হয়নি একটিও।

সরেজমিনে দেখা যায়, ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া জন্ম ও প্রয়ান দিবস উপলক্ষ্যে চলছে ধোয়া-মোছার কাজ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে বেগম রোকেয়ার জন্মভূমি দেখতে এসে শিক্ষার্থী আবু বক্কর সিদ্দিক অনেকটা ক্ষোভ আর হতাশা নিয়েই জাগো নিউজকে জানান, যে আশা নিয়ে এসেছিলেন তার কিছুই দেখতে পেলেন না তিনি। বেগম রোকেয়ার জন্মভূমিতে গড়ে ওঠা স্মৃতিকেন্দ্রে ইটের বাড়ি আর চেয়ার-টেবিল ছাড়া কিছুই দেখতে না পেরে হতাশ হয়েই ফিরে যাচ্ছেন তিনি।


একই অভিমত ব্যক্ত করেন দিনাজুপুরের বিরামপুর থেকে আসা বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন প্রকল্পে কর্মরত সিরাজুল ইসলাম। কথা হয় স্মৃতিকেন্দ্রের নিরাপত্তা প্রহরী আব্দুল বাতেনের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে জানান, এক যুগ ধরে বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবন পাড়ি দিচ্ছেন। বেগম রোকেয়ার স্মৃতিকে ধরে রাখতে গিয়ে পারেননি সংসারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে, পারেননি ছেলে-মেয়েদের ভালো স্কুলে ভর্তি করাতে। বিনা বেতনে কাজ করতে গিয়ে আজ প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন তিনি।

স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল জাগো নিউজকে জানান, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অবহেলিত হয়ে আছে স্মৃতিকেন্দ্রটি। চাকরি বিধি এবং সাংবিধানিক যে অধিকার তাও খর্ব হয়েছে। স্মৃতিকেন্দ্রটি অবিলম্বে চালু করার জোর দাবি জানান তিনি। বেগম রোকেয়ার স্মৃতি কেন্দ্রে উপ-পরিচালক আব্দুল্যা-আল-ফারুক জাগো জানান, মন্ত্রী মহোদয় হাইকোর্টের রায়টি বাস্তবায়নের জন্য আন্তরিক রয়েছেন। এটি দ্রুত বাস্তবায়ন হবে বলে আমরা আশা করছি।

নারী জাগরণের অগ্রদূত, সমাজ সংস্কারক বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দের খোর্দ্দ মুরাদপুর গ্রামের এক সভ্রান্ত জমিদার পরিবারে। তার পিতা জহির উদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার, মাতা রাহাতুন্নেছা সাবের চৌধুরানী। খান বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে অল্প বয়সে বিয়ে হয় রোকেয়ার। মাত্র ২৮ বছর বয়সে তিনি স্বামীকে হারান।

তার জীবনদশায় অবরোধ বাসিনী, অর্ধাঙ্গী, সুলতানার স্বপ্ন, মতিতূর ছাড়াও অসংখ্য বই লিখেছেন বেগম রোকেয়া। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি কলকাতায় মারা যান। কলকাতার সোধপুরে সমাহিত করা হয় রোকেয়াকে। আজ ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়ার জন্ম ও প্রয়ান দিবস উপলক্ষ্যে পায়রাবন্দে বিভিন্ন কর্মসূচির পাশাপাশি শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপি রোকেয়া মেলা।


রংপুর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত কর্মসূচির মধ্যে বুধবার সকাল ৯টায় বেগম রোকেয়া স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পমাল্য অর্পণ, সকাল ১০ টায় পায়রাবন্দ জামে মসজিদে মিলাদ মাহফিল, বেলা ১১ থেকে ১২টা পর্যন্ত স্বেচ্ছায় রক্তদান ও রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা, বিকেল সাড়ে ৩টায় বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বিকেল ৪টায় আনুষ্ঠানিকভাবে মেলার উদ্বোধন।

দ্বিতীয় দিন বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, সাড়ে ১০টায় কবিতা আবৃত্তি, সাড়ে ১১টায় রচনা প্রতিযোগিতা, বিকেল ৫টায় আলোচনা সভা। শুক্রবার বিকেল ৩টায় বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ৪টায় আলোচনা সভা, ৫টায় পুরস্কার ও পদক বিতরণ, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় নাটিকা ও সন্ধ্যা ৭টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে শেষ হবে বেগম রোকেয়া দিবসের কর্মসূচি।

জিতু কবীর/বিএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।