করোনা থেকে বাঁচাবে নতুন অ্যান্টিবডি থেরাপি
করোনাভাইরাস থেকে বাঁচাতে আশার আলো দেখাচ্ছে নতুন অ্যান্টিবডি থেরাপি। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি রেজেনারন এই অ্যান্টিবডি থেরাপি উদ্ভাবন করেছে। করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে গুরুতর রোগীদের এই থেরাপির মাধ্যমে মৃত্যু অনেক কমিয়ে আনা যাচ্ছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
ব্রিটেনের বেশ কিছু হাসপাতালে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের বিরুদ্ধে যাদের দেহে আপনা আপনি অ্যান্টিবডি তৈরি হয় না এমন লোকজনের জীবন বাঁচিয়েছে রেজেন-কোভ থেরাপি। বিভিন্ন হাসপাতালের ৯ হাজার ৭৮৫ রোগীর ওপর গবেষণা চালানো হয়েছে। নতুন এই থেরাপি দেয়া হয়েছে এমন এক তৃতীয়াংশ রোগীর দেহে করোনা নেগেটিভ হয়েছে এবং তারা আগের চেয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
করোনার অন্যান্য চিকিৎসা যেমন স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ডেক্সামিথাসোন বা প্রদাহ কমার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত টোসিলিজুমাব জাতীয় ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে ২০ শতাংশ রোগী বেঁচে গেছেন। তবে রেজেন-কোভ রোগীদের হাসপাতালে অবস্থানের সময়ও কমিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ আগে যেখানে একজন রোগীকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১৭ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে সেখানে নতুন এই থেরাপির কারণে সে সময় কমে হয়েছে ১৩ দিন।
ক্যাসিরিভিমাব এবং ইমডেভিমাব নামের দু'টি মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি থেকে তৈরি হয়েছে রেজেন-কোভ। এই অ্যান্টিবডিগুলো প্রোটিন সমৃদ্ধ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যা জীবাণুকে বিশেষভাবে লক করে অক্ষম করে ফেলে। ক্যাসিরিভিমাব এবং ইমডেভিমাব উভেয়েই করোনভাইরাসের ‘স্পাইক’ প্রোটিনের বিভিন্ন অংশকে আটকে ফেলে ভাইরাসের কোষগুলোকে সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে। একটির পরিবর্তে দুটি অ্যান্টিবডি ব্যবহার করে করা এই চিকিত্সার মাধ্যমে ভাইরাসের বিকশিত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে।
গত অক্টোবরে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাকেও এ ধরনের পরীক্ষামূলক একটি অ্যান্টিবডি প্রয়োগ করা হয়েছিল। ট্রাম্প করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে তাকে রেজেনেরন ফার্মাসিউটিক্যালসের তৈরি রেজেন-কোভটু নামের একটি ওষুধ প্রয়োগ করার আগেই মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন পেয়েছিল।
সে সময় মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছিল, ট্রাম্পই পৃথিবীতে প্রথম ব্যক্তি যিনি করোনা চিকিৎসায় এই ওষুধ পেয়েছেন। ওষুধটি সম্পর্কে ট্রাম্প পরবর্তীকালে বলেছিলেন, ‘এটি দারুণভাবে কাজ করেছে।’
মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে গত ডিসেম্বরে সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জন্স হপকিন্স সেন্টার ফর হেলথ সিকিউরিটির শীর্ষ কর্মকর্তা জিজি কুইক গ্রনভল বলেন, ‘আমাদের শরীরে যখন কোনো জীবাণুর সংক্রমণ হয় তখন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিভিন্ন রকম অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এই অ্যান্টিবডিগুলো আক্রমণকারী জীবাণুগুলোর সঙ্গে লড়াই করে।’
তিনি বলেন, ‘শক্তিশালী অ্যান্টিবডিগুলো জীবাণুর সঙ্গে লেগে থাকে- যেমন এক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের সঙ্গে লেগে থাকে এবং ভাইরাসগুলোকে কোষে আক্রমণ করা থেকে প্রতিরোধ করে। তাই ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে অ্যান্টিবডির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি কোনো নির্দিষ্ট ধরণের অ্যান্টিবডিকে বাছাই করে সেটিকে নিস্ক্রিয় করে দেয় এবং অ্যান্টিবডির একটি বিশুদ্ধ সংস্করণ তৈরি করে যা ওষুধ হিসেবে কাজ করে।’
ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভারত রেজেন-কোভ থেরাপির অনুমোদন দিয়েছে। তবে ব্রিটেন এবং অন্যান্য কিছু দেশে এ নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান সৌম্য স্বামীনাথন বলেন, রেজেন-কোভের ফলাফল খুবই ভালো। তবে তিনি সতর্ক করেছেন যে, বিশ্বব্যাপী একচেটিয়া মনোক্লোনাল-অ্যান্টিবডি ব্যবহারে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
চিকিৎসা বিষয়ক ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা ওয়েলকাম ট্রাস্ট, আন্তর্জাতিক এইডস ভ্যাকসিন উদ্যোগ (আইএভিআই) বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে গবেষণা চালিয়ে দেখেছে এগুলো অনেক দেশেই সহজলভ্য নয়। এর তিন-চতুর্থাংশের বেশি বাজারই আমেরিকা, কানাডা এবং ইউরোপে।
ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানি এর একটি বড় অংশ নিজেদের ব্যবহারের জন্য সংগ্রহ করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র ২৬০ কোটি মার্কিন ডলারে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ ডোজ কেনার বিষয়ে সম্মতি জানিয়েছে। ওই একই সময়ে ২ লাখ ডোজ কিনতে ৪৮ কোটি ৭ লাখ ডলার ব্যয় করেছে জার্মানি।
মনোক্লোনাল-অ্যান্টিবডি থেরাপির উৎপাদন খুবই কম। সাধারণত ধনী দেশগুলোরই এটি উৎপাদনের সামর্থ্য রয়েছে। রেজেন-কোভের একটি ডোজে কয়েক হাজার ডলার খরচ করতে হয় যা দরিদ্র দেশগুলোর জন্য সম্ভব নয়।
সৌম্য স্বামীনাথন বলেন, এ ধরনের চিকিৎসা সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করতে হলে বিশ্বজুড়ে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির ফ্যাক্টরি আরও বাড়াতে হবে।
এখন পর্যন্ত কোভিডের চিকিৎসায় অ্যান্টিবডি থেরাপি নিয়ে খুব একটা আশা দেখা যায়নি। কিন্তু রেজেন-কোভের সফলতার খবর এই থেরাপির প্রতি মানুষকে আগ্রহী করে তুলছে। গত ডিসেম্বরে মার্কিন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ইলি লিলির অ্যান্টিবডি থেরাপি লি-কোভ৫৫৫ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের চিকিৎসায় সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। অপরদিকে গত ১৫ জুন অ্যাস্ট্রাজেনেকার একই ধরনের ওষুধের ব্যবহারও সবাইকে হতাশ করেছে।
বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই এখন ভ্যাকসিন কার্যক্রম চলছে। কিন্তু অনেক দেশ এখনও ভ্যাকসিন পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। যদি আগামী কয়েক মাসে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করা হয় তবে তা হয়তো ভ্যাকসিন উৎপাদনে প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ ভ্যাকসিন উৎপাদন ও সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
টিটিএন/জিকেএস