সেই ‘জল ঘোলা’ করেই পান করলেন বাইডেন!

খান আরাফাত আলী
খান আরাফাত আলী খান আরাফাত আলী , সহ -সম্পাদক , আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:২০ এএম, ২১ মে ২০২১

অডিও শুনুন

ইসরায়েলিদের দখলদারিত্বে মার্কিনিদের সমর্থনের ইতিহাস বহু পুরোনো। গত ৪৯ বছরে জাতিসংঘে ইসরায়েল-বিরোধী নিন্দাপ্রস্তাবে অন্তত ৫৩ বার ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ১০ মে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় দখলদাররা নতুন করে বোমা হামলা শুরু করলে তাতেও স্বভাব ও স্বার্থগত সমর্থন দেয় মার্কিন প্রশাসন। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে অন্তত তিনবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর কাছে ফোন করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আর তার সমর্থন পেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে ইসরায়েলি দখলদাররা। এতে প্রাণ যায় অন্তত ২৩২ ফিলিস্তিনির, যার মধ্যে ৬৫ নিষ্পাপ শিশুও রয়েছে।

তবে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধযোদ্ধাদের পাল্টা জবাবে অনেকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় ইসরায়েল। তারা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি হামাসসহ অন্য ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো এবার এত জোরালো জবাব দেবে। এসব গোষ্ঠী গত ১১ দিনে কয়েক হাজার রকেট নিক্ষেপ করেছে ইসরায়েলের দিকে। এতে তেল আবিবের প্রধান বিমানবন্দর বন্ধই হয়ে যায়। আঘাত হানা হয় আরও কয়েকটি বিমানবন্দর, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়। এর মধ্যে ইসরায়েলের বেশ কয়েকটি তেল-গ্যাস স্থাপনাতেও রহস্যজনকভাবে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। অবশ্য এতে ফিলিস্তিনি রকেট হামলার যোগসূত্র থাকার কথা স্বীকার করেনি দখলদাররা।

Biden-2

ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের পাল্টা হামলায় ইসরায়েলে একাধিক বিদেশিসহ অন্তত ১২ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও কয়েকশ’ মানুষ। এমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে মোটমাট আড়াইশ’ মানুষের প্রাণহানির পর অবশেষে বোধোদয় হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের। গত বুধবার নেতানিয়াহুর কাছে তৃতীয় ফোনকলে যুদ্ধবিরতিতে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি। কিন্তু রক্তের নেশায় বুদ হয়ে থাকা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এতে কর্ণপাত করেননি। বরং পরেরদিনই তিনি হামলা আরও জোরদার করার ঘোষণা দেন। এতে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে।

এছাড়া বাইডেনের দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অন্য নেতারাও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত বন্ধের জন্য তার ওপর চাপ দিতে থাকেন। শেষপর্যন্ত বৃহস্পতিবার নেতানিয়াহুকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করাতে সক্ষম হন জো বাইডেন। এরপরই বন্ধ হয়েছে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর টানা বিমান হামলা।

এ নিয়ে শুক্রবার ভোরে হোয়াইট হাউস থেকে একটি ভিডিওবার্তা দিয়েছেন বাইডেন। সেখানে তাকে বলতে শোনা যায়, আমি বিশ্বাস করি, ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের সমান সুরক্ষা ও নিরাপত্তায় বেঁচে থাকা এবং সমান স্বাধীনতা, উন্নতি ও গণতন্ত্র উপভোগ করার অধিকার রয়েছে। আমার প্রশাসন সেই লক্ষ্যে সম্পূর্ণ ও নিরলস কূটনীতি অব্যাহত রাখবে।

এ নেতা আরও বলেন, আমি বিশ্বাস করি, আমাদের উন্নতির একটি সত্যিকারের সুযোগ এসেছে এবং এর জন্য কাজ করতে আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

এদিন মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুখে ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সমান অধিকারের কথা শোনা গেলেও এর আগে তিনি একাধিকবার ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ বলে মন্তব্য করেছেন। এমনকি ফিলিস্তিনের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বলতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি তিনি।

Biden-2

অবশ্য মার্কিন প্রশাসনের এই ইসরায়েল-প্রেম নতুন কিছু নয়। ইসরায়েলি বাহিনী সম্প্রতি হামলা শুরুর পর গাজা থেকে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা পাল্টা রকেট ছুড়তে শুরু করলে ব্যাপক ক্ষেপে যান সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বাইডেন প্রশাসনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, নতুন প্রেসিডেন্টের দুর্বলতার কারণেই তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েল হামলার শিকার হচ্ছে।

ট্রাম্প দাবি করেন, তার শাসনামলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি বজায় ছিল, কারণ তখন ইসরায়েলের শত্রুরা জানত, যুক্তরাষ্ট্র শক্তভাবে ইসরায়েলিদের পাশে রয়েছে আর তারা হামলার শিকার হলে মোক্ষম জবাব দেয়া হবে। কিন্তু বাইডেনের আমলে বিশ্ব ক্রমেই সহিংস এবং অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এর কারণ বাইডেনের দুর্বলতা এবং ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনের অভাব, যা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের নতুন হামলার মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

তবে ইসরায়েল-প্রেম দেখাতে দেরি করেননি বাইডেন। ট্রাম্পের সমালোচনার ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর কাছে সরাসরি ফোন করেন তিনি। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরায়েলিদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, হাজার হাজার রকেট ছোড়া হলে তা থেকে আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে ইসরায়েলের।

Biden-2

অর্থাৎ, বাইডেনের নজরে ইসরায়েল যুদ্ধবিমান-ট্যাংক নিয়ে বোমাবর্ষণ করে মানুষ হত্যা করলে সেটি ‘আত্মরক্ষা’, কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এর জবাব দিলে সেটি হয়ে যাচ্ছে ‘সন্ত্রাসী হামলা’। দখলদার ইসরায়েল আক্রমণ করলে সেটি ‘আইনসিদ্ধ’, আর ফিলিস্তিনিরা জবাব দিলে তা ‘অন্যায়’।

এমন দ্বিমুখী নীতির কারণে নিজের দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভেতরেই সমালোচনার মুখে পড়েন বাইডেন। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘাত বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে তার প্রতি আহ্বান জানান মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের ১৩০ জন সদস্য। একই দাবি জানান ২৮ জন সিনেটরও। এরপরই অবস্থান বদলাতে শুরু করেন বাইডেন। আর তার ফলও মিলেছে হাতেনাতেই। ১১ দিন পর অবশেষে শান্ত হয়েছে অবরুদ্ধ উপত্যকা।
অর্থাৎ বাইডেন প্রশাসন সেই ‘শান্তি’র পথেই আসল, শুধু বহুদূরের জল ঘোলা করে তারপর! আর তার খেসারত দিতে হচ্ছে বাস্তুচ্যুত অর্ধ-লক্ষাধিক ফিলিস্তিনিকে।

কেএএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।