নারী নির্যাতনের কারণে ৪৫ বছরের অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ
সমাজের সর্বক্ষেত্রে প্রশংসনীয় অবদান রেখেও নারীরা আজ ক্রমাগত নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, যা আমাদের ৪৫ বছরের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নারীর বিষয়ে সমাজের পুরুষদের বিশেষ করে তরুণ সমাজের যে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিকতা সেখান থেকে আধুনিক যুক্তিযুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের জন্যে সচেতনতার প্রয়োজন। সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীসমাজকে সকল ক্ষেত্রে সমঅংশগ্রহণের সুযোগ করে না দিলে এবং নারী ও কন্যাশিশুদের বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতা বন্ধ না হলে সমাজ ও রাষ্ট্র এগিয়ে যেতে পারবে না।
রোববার বিকেলে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ-২০১৫ উপলক্ষে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নারী নির্যাতন বিরোধী পুরুষ সংহতি সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সমাবেশটি আয়োজন করে।
এসময় একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওই জরিপ (২০১৩) অনুযায়ী জানা যায়- দেশের প্রায় ৮৭ শতাংশ নারী তার বাড়িতে স্বামী বা পুরুষের হাতে নির্যাতিত হন। এরমধ্যে ৭৩ শতাংশ নারী ভয়ে কিংরা লোকলজ্জার কারণে সেটা বাইরে প্রকাশ হতে দেয় না। জাতিসংঘের জরিপ অনুসারে সারা বিশ্বে ৩ জন নারীর মধ্যে ২ জনই পুরুষের হাতে নির্যাতিত হন।
বক্তারা বলেন, নারী ও পুরুষের সম্মিলিত সাধনাই সমাজের শক্তি, মানবতার শক্তি। নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের পেছনে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। তাই নারী নির্যাতন বন্ধে মানসিকতার পরিবর্তন বেশি জরুরি। আর এজন্য পরিবারই হতে পারে প্রতিরোধের দুর্গ।
সমাবেশে আয়েশা খানম বলেন, নারীরা আজ সর্বক্ষেত্রে অবদান রাখছে কিন্তু ক্রমাগত নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, যা আমাদের ৪৫ বছরের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নারীর বিষয়ে সমাজের পুরুষদের বিশেষ করে তরুণ সমাজের যে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিকতা সেখান থেকে আধুনিক যুক্তিযুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের জন্যে সচেতনতার প্রয়োজন।
তিনি বলেন, সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীসমাজকে সকল ক্ষেত্রে সমঅংশগ্রহণের সুযোগ করে না দিলে এবং নারী ও কন্যাশিশুদের বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতা বন্ধ না হলে সমাজ ও রাষ্ট্র এগিয়ে যেতে পারবে না। তাই আজ আমাদেরর মূল লক্ষ্য হচ্ছে পরস্পরের সহযোগিতা, সহমর্মীতা একটি মানবিক ও সাংস্কৃতিক সমাজ গড়ে তোলা।
সংগঠকের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পুরুষদের সর্বাগ্রে এগিয়ে আসাতে হবে। নারী নির্যতন বন্ধে সকল আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রস্টি মফিদুল হক বলেন, যেকোনো সহিংসতার শেকর অনেক বিস্তৃত। যখন সেটা ভয়াবহ হয় তখন সেটা ব্যক্তিপর্যায় থেকে বেরিয়ে সামজিক ব্যাধিতে রুপ নেয়। নারী নির্যাতন একটি সামাজিক ব্যাধি।
নারী নির্যতন হলে শুধু নারী নয়, সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পুরুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
টিভি ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রহমান বলেন, যে সমাজ নারীকে সম্মান দেয় না সে সমাজ বর্বর সমাজ। নারী নির্যাতন প্রতিরোধের আন্দোলন কেবল নারীসমাজের নয়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের শিক্ষিত বিবেকবান সকল মানুষের সামাজিক দায়িত্ব। অভিজ্ঞতায় দেখেছি গাইবান্ধার প্রত্যন্ত অঞ্চলে হোক কিংবা পাচতারকা হোটেলের কোন অনুষ্ঠানে হোক প্রতিটি নারী নির্যাতনের ঘটনায় পুরুষ দায়ী কেননা পুরুষকে নারীরা তাদের মালিক ভেবে থাকে। এ মানসিকতা পরিবর্তনটা সবচেয়ে জরুরি।
অন্যান্যরা বলেন, নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তরুণ ও পুরুষসমাজকে এগিয়ে আসা সবচাইতে জরুরি। সমাজে নারী প্রত্যয়টিকে আলাদা করলে নারী কখনই তার যথার্থ মর্যাদা পাবেনা। নারীকেও নারীর অধিকার রক্ষায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যৌতুক, পারিবারিক সহিংসতা ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, প্রশাসনকে আরো সক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।
এসময় গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের জেন্ডার অসংবেদনশীল বিজ্ঞাপন প্রচারের নমুনা তুলে ধরে আরো জেন্ডার সংবেদনশীল হবার আহ্বান জানান বক্তারা। পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকেও জেন্ডার সংবেদনশীলতার বিষয়সমূহ তারা অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেন।
পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ যা নারী নির্যাতনের সংস্কৃতিকে সমর্থন করে তা প্রতিরোধ ও নিরোধের লক্ষ্যে জাতীয় নীতি ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করার কথা বলেন বক্তারা। প্রতিটি পুরুষকে যার যার অবস্থান হতে পরিবার থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে একটি নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতামুক্ত সমাজ গড়ে তোলার।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানমের সভাপতিত্বে সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, মৃণাল সরকার, কলামিস্ট মুহম্মদ হিলালউদ্দিন, টিভি ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রহমান, চিকিৎসক ডা. এম.এইচ চৌধুুরী লেলিন, আবৃত্তিকার ভাস্মর বন্দোপাধ্যায়, সাংবাদিক বাসুদেব ধর, প্রণব সাহা, আইনজীবী এস.এম.এ সবুর, ব্যবসায়ী আরাফাত আহমেদ রাজীব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হেলাল হোসেন ঢালী, উন্নয়নকর্মী চিররঞ্জন সরকার প্রমুখ।
সমাবেশ পরিচালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের ডিরেক্টর অ্যাড. মাকছুদা আখতার।
এমএইচ/এসএইচএস/আরআইপি