‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে উদীয়মান অর্থনীতি
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি অনেক। এ দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে, যা এখন অনেক দেশের কাছেই আদর্শ। স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকে এই ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন নিয়ে শুধু স্থানীয় পর্যায়েই নয়, বিশ্বপরিসরেও ভূয়সী প্রশংসা চলছে।
কয়েক দশকে শিল্প, বাণিজ্যে অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। ৫০ বছর আগে এই মাসেই গণহত্যা, দারিদ্র্য আর অনাহারের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ। হেনরি কিসিঞ্জার তখন দেশটিকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছিলেন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ ছবিগুলো বিশ্বে বাংলাদেশের একটি হতাশাজনক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দেখে প্রতিবেশী অনেক দেশই হতবাক। দারিদ্র্য নির্মূলে বাংলাদেশের বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রশংসা করছে বিভিন্ন দেশ। সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট নিকোলাস ক্রিস্টফ বাংলাদেশের প্রশংসা করে বলেছেন, দারিদ্র্য নির্মূলে মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে পারে। এই সাংবাদিক দুবার পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি গত ১০ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমসে দারিদ্র্য নির্মূলে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন।
১৯৯১ সালের এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে এক লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। নিকোলাস ক্রিস্টফ বলেন, আমি তখন নিউইয়র্ক টাইমসে লিখেছিলাম, ‘বাংলাদেশ অত্যন্ত দুর্ভাগা দেশ’। তখনকার প্রেক্ষাপটে আমি ঠিকই লিখেছিলাম। এ ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছাড়াও বাংলাদেশকে তখন অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছিল। কিন্তু গত তিন দশকে আমার সব অনুমান ভুল প্রমাণিত করে বাংলাদেশ অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে।
তার কথা একদমই মিথ্যা নয়। সত্যিই সেই দারিদ্র্যপীড়িত দেশটি আজ আর সেই দুর্দশার অবস্থায় নেই। ক্রমাগত বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি এখন সমৃদ্ধ।
পোশাক খাতে সুপরিচিত ব্যবসায়ী এ বি এম সামছুদ্দিন। হান্নান গ্রুপের মালিক ও চেয়ারম্যান তিনি। বাংলাদেশের উন্নয়নশীল অর্থনীতি থেকে বেশ সুবিধা পাচ্ছেন তিনি। ১৯৯৮ সালে মাত্র ১১০টি মেশিন এবং ২৫০ জন কর্মীকে নিয়ে একটি সোয়েটার ফ্যাক্টরির কাজ শুরু করেন এই ব্যবসায়ী। এখন হান্নান গ্রুপের পাঁচটি ফ্যাক্টরি দুই ডজন ইউরোপীয় ব্র্যান্ডকে তাদের পণ্য সরবরাহ করছে। এখানে এখন কাজ করছে ১০ হাজারের বেশি কর্মী।
৬৬ বছর বয়সী এ বি এম সামছুদ্দিন এএফপিকে বলেন, তার প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বিক্রি ১০ কোটি ডলারের বেশি। তিনি বলেন, ‘আমি জিরো থেকে আজ রীতিমত হিরো।’
রাস্তাঘাট, বন্দর ও জ্বালানি সুবিধার মতো সুনির্দিষ্ট অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সরকারের প্রশংসা করে তিনি পূর্বাভাস দিয়েছেন যে, ১৬ কোটির বেশি মানুষের দেশটিতে এটা হতে যাচ্ছে সমৃদ্ধির এক নতুন যুগ।
বাংলাদেশে প্রায় ত্রিশ লাখ গার্মেন্টস কর্মীর পরিশ্রমে দেশটি এখন চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত পেয়েছে।
একসময় এদেশের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। কিন্তু এখন এই অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে।
নরওয়ের গবেষক ইরিক জি জনসেন গত চার দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ নিয়ে নিবিড়ভাবে পড়াশুনা করছেন। তিনি বলছেন, বর্তমানে ১০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করেন।
তার সর্বশেষ প্রকাশিত বইয়ে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে ধানের ফলন অনেক বেড়েছে যা অবাক করার মতো। দেশটির ১৯৭১ সালে মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৪১ বছর সেখানে এখন মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭৩ বছর।
গত এক দশকে বাংলাদেশের বার্ষিক অর্থনীতি ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০২০ সাল থেকে মাথাপিছু জিডিপি চারগুণ বেড়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ‘উন্নত দেশ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে কাজ করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার।
কয়েকটি সূচকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশে অর্থনীতির চিত্র অনেকটাই পাল্টে গেছে। বিবিএস এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া বিভিন্ন তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিলো মাত্র ২৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেসময় জিডিপি'র আকার ছিল ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় মাত্র ১২৯ ডলার। দারিদ্রের হার ছিল ৭০ শতাংশ।
পঞ্চাশ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, রফতানি আয় বহুগুণে বেড়ে মিলিয়ন ডলার থেকে এসেছে বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ২০২০ সালের হিসেবে যা ৩৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
জিডিপির আকার ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে বেড়েছে ৩৬৯ গুণ। পরিমাণে যা প্রায় ২৭ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬ গুণ অর্থাৎ ২ হাজার ৬৪ ডলার। দারিদ্রের হার কমে হয়েছে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ।
একসময় যে দেশটি তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত ছিলে এখন বলা হচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে সেই দেশটিই হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। স্বল্পোন্নত থেকে এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে এসেছে বাংলাদেশ।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভূক্ত হয়। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের অন্তর্ভূক্ত হতে ৩টি শর্ত রয়েছে। ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ৩টি শর্তই পূরণ করে। পরে ২০২১ সালেও ৩টি শর্ত পূরণে দক্ষতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ।
জাতিসংঘের নিয়মানুযায়ী, কোনো দেশ পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় উত্তরণের মানদণ্ড পূরণে সক্ষম হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায়। বাংলাদেশ সেই সুপারিশ পেয়েছে।
জাতিসংঘের ৩টি শর্তের প্রথমটি হচ্ছে- মাথাপিছু আয়, অর্থনৈতিক ঝুঁকি এবং সবশেষে মানবসম্পদ উন্নয়ন। মাথাপিছু আয়ে জাতিসংঘের শর্ত পূরণে ন্যুনতম দরকার এক হাজার ২শ ৩০ ডলার। ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল দুই হাজার ৬৪ ডলার।
অর্থনৈতিক ঝুঁকি কতটা আছে, সেটা নিরূপণে ১শ স্কোরের মধ্যে ৩২ এর নিচে স্কোর হতে হয়। বাংলাদেশ সেখানে নির্ধারিত মানের চেয়েও ভালো করে ২৫’র নিচে রয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন যোগ্যতায় দরকার ৬৬'র উপরে স্কোর। বাংলাদেশ সেখানে পেয়েছে আরো বেশি অর্থাৎ ৭৩ দশমিক ২ স্কোর।
এই সূচকের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে মূলতঃ শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৫৩ জন। যেটি ২০১৮ সালে এসে প্রতি হাজারে মাত্র ২২ জনে নেমে আসে।
এছাড়া বিবিএস ১৯৮১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর সংখ্যা দিয়েছে প্রতি হাজারে ২শ ১২ জন। যেটি ২০১৮ সালে হয়েছে প্রতি হাজারে ২৯। ১৯৯১ সালে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ৪.৭৮ শতাংশ। সেটি এখন ১.৬৯ শতাংশে নেমে এসেছে।
অপুষ্টি এবং মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি সেখানে স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বেসরকারি এনজিও ও প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে।
বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠান প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া এবং সেবা নিতে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।সরকারের সঙ্গেও আর্থিক কিংবা অন্যান্য সুবিধা নিয়ে যৌথভাবে কাজ করেছে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মানবসম্পদ সূচকে অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নিরেট অর্থনৈতিক সক্ষমতাও এমনভাবে বেড়েছে যেখানে বিদেশি ঋণ সহায়তা নির্ভর উন্নয়নে অভ্যস্ত বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করছে ৩০ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রজেক্ট পদ্মাসেতু।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেটি গেলো ৫০ বছরে বাংলাদেশের রূপান্তরের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন।
অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে গত কয়েক দশকে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের রফতানি আয় বেড়েছে, রেমিটেন্স বেড়েছে, কৃষি-শিল্পের উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান বেড়েছে, অবকাঠামো উন্নয়নও হয়েছে।
মূলত প্রান্তিক পর্যায়ে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এবং উৎপাদন, রফতানি বৃদ্ধি -সবমিলিয়েই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশে।
শুরুতে কৃষি খাত এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখলেও ৮০'র দশক থেকে সেখানে মূল ভূমিকা রাখতে শুরু করে শিল্প খাত। আরো নির্দিষ্ট করে বললে তৈরি পোশাক খাত। রফতানি এবং কর্মসংস্থান দুটো ক্ষেত্রেই তৈরি পোশাক খাতের বড় ভূমিকা আছে।
বাংলাদেশ রফতানি করে এখন যে আয় করে তার ৮৩ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। অন্যদিকে এ খাতে কাজ করা লাখ লাখ শ্রমিক যাদের সিংহভাগই নারী। তাদেরও জীবন মানের উন্নয়ন ঘটেছে।
সূত্র : এএফপি, বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস।
টিটিএন/এমকেএইচ