মাতৃভূমির টানে সিদ্ধান্তে অটল একটি পরিবার
কুড়িগ্রামের বিলুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ারছড়ার একটি পরিবার মাতৃভূমির টানে দেশেই থেকে যাচ্ছেন। অথচ ওই পরিবারের কর্তা জয়নাল আবেদীন স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের পাঁচ সদস্যকে ফেলে রেখে একাই ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মাতৃভূমির টানে পরিবারের এই সদস্যরা তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকলে ভারতের নাগরিকত্ব একাই গ্রহণ করেছেন জয়নাল আবেদীন।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বিলুপ্ত দাসিয়ারছড়া ছিটমহলের বোর্ডেরহাট চেয়ারম্যানটারী গ্রামের বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন (৪৫)। তিনি জন্মদাতা মা, স্ত্রী ও চার সন্তানের মায়া ত্যাগ করে বাংলাদেশে তাদের রেখে একাই ভারতে চলে যাওয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আগামী ২৪ নভেম্বর ভূরুঙ্গামারী উপজেলার বাগভান্ডার-সাহেবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে তিনি ভারত যাবেন। এ যাত্রায় কারও অনুরোধ তার মমতা জাগাতে পারেনি।
জয়নাল ২৩ বছর আগে বিয়ে করেন একই এলাকার আকলিমাকে (৪০)। শুধু ১৩ শতক ভিটে টুকুতে ৪টি টিনের ছাপড়া ঘর ছাড়া সম্বল বলতে কিছুই নেই তার। দিনমজুরিতে কাটে সংসার। বাবা নছর উদ্দিন মারা গেছেন আট বছর আগে। এখন বৃদ্ধ মা, স্ত্রী, এক ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে সংসার। বড় ছেলে আরিফুল (২০) ৭/৮ বছর থেকে ভারতের হারিয়ানা রাজ্যের রউতক জেলার শাপলা থানার হাসানগড় গ্রামের বিশাল নামক ইট ভাটায় কাজ করছে। যৌথ গণনার সময় এসে বাংলাদেশে থাকার মতামত দিয়ে আবারও আরিফুল চলে যায় তার কর্মস্থলে। তার ইচ্ছে বাবাসহ সবাই এখানে থাকবে। তার আয়ে সংসার চলবে। জয়নালের বড় মেয়ে জেসমিন আক্তারের (১৮) বিয়ে হয়েছে ৮/৯ মাস আগে। মেয়ে-জামাই বাংলাদেশ ছেড়ে যাবে না। মেঝো মেয়ে ইয়াসমিন (১২) গঙ্গারহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে।
জয়নাল আবেদীনের মা জামেলা বেওয়া ছেলের ভারত যাওয়ার কথা জানতে চাইতেই কেঁদে বলেন, মোর একটা ব্যাডা, উয়াক ভারত যাবার দিব্যার নং। জয়নালের স্ত্রী আকলিমা বেগমের কথার ভেতর একটি আর্জি। যেন তার স্বামী দেশে থাকেন। তিনি বলেন, জীবনটা এটি (এখানে) পাড় করলং। এ্যালা হামরা (আমরা) ক্যা ভারত যামো। ওমাক (জয়নালকে) বাংলাদেশত থাকার ব্যবস্থা করি দেন তোমরা গুলা। জয়নাল তার পরিবারের লোকজনকে বারবার ভারত যেতে মত দেয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু তাতে রাজী হয়নি পরিবারের অন্য কেউই।
জয়নালের ছোট মেয়ে জেনিফা বলেন, সবার বাবা থাকবে। আমার থাকবেনা। স্কুলে সবার বাবা যাবে আমার বাবা যাবেনা। এজন্য মনটা খুব খারাপ লাগে। বাবাকে এখানে থাকতে বলছি, কিন্তু থাকবেন না। তুমি বাবার সাথে গেলেনা কেন এমন প্রশ্নের জবাবে জেনিফা বলে উঠলো, আমার জন্ম এখানে আমি মাতৃভূমি ছেড়ে যাব কেন?
প্রতিবেশি আতাউর রহমান বলেন, আমরা ভারতে যাচ্ছি পরিবারের সবাই। কিন্তু জয়নাল তার মা, স্ত্রী ও সন্তান ফেলে যাচ্ছে। এটা অমানবিক। তাকে ও তার স্ত্রীকে বোঝানো হয়েছে। কেউই বোঝার চেষ্টা করেনা। পরে কষ্ট পাবে।
জয়নালের চাচা আবেদ আলী (৭০) বলেন, ভাতিজাকে বোঝাতে পারলাম না। তারা দুই দেশে ভাগ হচ্ছে আমরা কষ্ট পাচ্ছি। চাচী সুফিয়া বেগম ও খোতেজা বেগম বলেন,কদ্দিন এক সাথে থাকলং। মাও, বউ-ছোয়াক থুইয়া জয়নালই বা থাকবে ক্যামন করি। বাবার ১৩ শতক ভিটেমাটির মধ্যে প্রাক জরিপে নিজ নামে পাওয়া ৯ শতক জমি বিক্রি করতে তোরজোড় শুরু করেছে জয়নাল।
জয়নাল কথার শুরুতে আক্ষেপ করে বলেন, আমি ভারতের নাগরিক। কেউ কোটি টাকা দিলেও আমি বাংলাদেশে থাকবোনা। এদেশে থেকে উন্নতি হবেনা। ভারতে গেলে কাজ মিলবে। জমি বিক্রি করলে স্ত্রী-সন্তানরা থাকবে কোথায় ? এ প্রশ্নের তার সাফ জবাব, আমার কিছু করার নেই। তাদের বলছি আমার সঙ্গে যেতে। তারা যাবেনা। যেখানে ইচ্ছে সেখানে থাকবে। এটি প্রত্যেক নাগরিকের একান্ত বিষয়। তারা যেখানে থাকতে চাইবে। তাদের বিষয়।
ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন মাহমুদ জানান, অনেকে তাদের অপশন চেঞ্জ করার আবেদন করেছে। তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে দুই দেশের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এছাড়াও নির্দেশনা রয়েছে কাউকে ভারতে যেতে বাধ্য করা হবে না। এ অর্থে ভারতের ট্রাভেল পাসধারীরা যেতে না চাইলে বাংলাদেশে থেকে যেতে পারবেন।
জেলা প্রশাসক কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের গত ৩১ জুলাই মধ্যরাতে কুড়িগ্রামের অভ্যন্তরে ১২টিসহ বাংলাদেশ-ভারতের ১৬২টি ছিটমহল দেশ দুটির স্বাধীন ভু-খণ্ডের সঙ্গে একীভূত হয়। এর আগে ৬ থেকে ১৬ জুলাই ছিটমহলগুলোতে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ গণনা এবং অধিবাসীদের নাগরিকত্ব বিষয়ে মতামত গ্রহণ করা হয়। এগারো দিনব্যাপী যৌথ জনগণনা জরিপ চলাকালীন ভারত যেতে কুড়িগ্রামের ৩টি ছিটমহলের ৩০৫ জন মতামত প্রদান করেন। এদের মধ্যে ফুলবাড়ীর দাশিয়ারছড়া থেকে ৫৮টি পরিবারের ২৮১ জন এবং ভূরুঙ্গামারীর ২টি ছিটের ৬ পরিবারের ২৪ জন সদস্য ভারত যাবেন। ভারতের নাগরিকত্ব বহাল রাখার জন্য ৩০৫ জনের মধ্যে ২৮১ জন ট্রাভেল পাস সংগ্রহ করেছেন। এদের মধ্য থেকে দাশিয়ারছড়ার ১৯টি পরিবারের ৭০ জন নাগরিক তাদের মত পাল্টিয়ে এ দেশে থাকতে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমর ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বরাবর আবেদন করেছেন।
কুড়িগ্রামের বিলুপ্ত ছিটমহলের যারা ভারত যেতে চান তাদের ৩ দফায় ভূরুঙ্গামারী বাগভাণ্ডার ও ভারতের সাহেবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হবে। প্রথম দফায় আগামী ২২ নভেম্বর দাশিয়ারছড়ার ১০টি পরিবারের ৪৮ জন এবং ভুরুঙ্গামারীর ৬ পরিবারের ২৪ জন, ২য় দফায় ২৪ নভেম্বর দাশিয়ারছড়ার ১৯টি পরিবারের ১১৫ জন এবং ২৬ নভেম্বর বাকিদের নিয়ে যাওয়া হবে। কেউ যদি কোনো কারণে উল্লেখিত তারিখে যেতে না পারে তাদের জন্য ২৯ নভেম্বর রিজার্ভ ডে রাখা হয়েছে।
এমএএস/পিআর