মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে : গণতদন্ত কমিটির রিপোর্ট
মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ২০১৫-১৬ সেশনের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে মর্মে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে গণতদন্ত কমিটি। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র শিক্ষক লাউঞ্জে গণতদন্ত কমিটির প্রকাশিত প্রতিবেদনে একথা জানানো হয়। একইসঙ্গে নতুনভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
গণতদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘সকল তথ্য-প্রমাণ সাক্ষ্য ও পরিস্থিতি নানা দিক বিবেচনায় মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ ২০১৫-১৬ সেশনের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন পত্র ফাঁস হয়েছে। নতুনভাবে মেডিকেল পরীক্ষা নেওয়ার সুপারিশ করছি।’
গত ১৯ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র শিক্ষক লাউঞ্জে সমাজের বিভিন্ন স্তরের নাগরিকদের সমন্বয়ে মোট ১৭ সদস্যের ‘মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস বিষয়ক গণতদন্ত কমিটি’ গঠিত হয়।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদকে সেই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়। কিন্তু ১৭ সদস্য বিশিষ্ট ঘোষিত ওই কমিটির দু’জন সদস্য দায়িত্ব পালনে অপারগ হন, তাই ১৫ সদস্যের কমিটি ওপর অর্পিত হয়।
প্রতিবেদন প্রকাশের সময় তদন্ত কমিটির ১৩ জন উপস্থিত ছিলেন। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আহমেদ কামাল, অধ্যাপক ডা. ফজলুর রহমান, শিক্ষাবিদ এ এন রাশেদা, প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, ডক্টর তানজীমউদ্দিন খান, ডক্টর সামিনা লুতফা, অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা, প্রকৌশলী ফিদা হক, শিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবু এবং লেখক-সম্পাদক রাখাল রাহা। এ সময় ডা. শাকিল আক্তার ও ব্যারিস্টার সারা হোসেন উপস্থিত ছিলেন না।
গণতদন্ত কমিটির প্রকাশিত প্রতিবেদনটি মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সামনে পাঠ করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
ওই প্রতিবেদনের সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, যেহেতু, গত কয়েক বছরে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রায় নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে তার বিভিন্ন আলামতও পাওয়া গেছে, এরসঙ্গে শক্তিশালী বাণিজ্যিক জাল ও ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর যোগাযোগের বিষয়েও বিভিন্ন খবর পাওয়া গেছে। যেহেতু, মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার আগে প্রাপ্ত বা ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্রের সঙ্গে পরীক্ষার হলে দেয়া প্রশ্নপত্রের প্রায় সর্বাংশে মিল পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, পরীক্ষার আগে বিভিন্ন অঞ্চলের পরীক্ষার্থীরা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন পাবার প্রস্তাব পেয়েছে, যারা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন নিয়েছে তাদের ভর্তি নিশ্চিত হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে সারাদেশে আন্দোলন চলাকালে প্রশ্নপত্র ফাঁসেরই অভিযোগে র্যাব কর্তৃক অভিযুক্ত ও ধৃত ইউজিসি কর্মকর্তার রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে এবং তাঁর থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্য বা বক্তব্য জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি; এছাড়া যাদের ধরা হয়েছে তাদের কোনো বক্তব্য বা তথ্যও প্রকাশ করা হয়নি।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, যেহেতু একই ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলেও অনেকরকম অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। যেমন কেউ কম নম্বর পেয়ে মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছে, আবার বেশি নম্বর পাওয়া সত্ত্বেও কাউকে অপেক্ষমাণ তালিকায় রাখা হয়েছে। একই নম্বর পেয়ে কেউ মেধা তালিকায় কেউ অপেক্ষমাণ তালিকায়।
যেহেতু, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ নিয়ে কোনো তদন্ত না করে তড়িঘড়ি ভর্তির উদ্যোগ নিয়েছে। সেহেতু এই সবভর্তি পরীক্ষায় ব্যাপক অনিয়ম ও বাণিজ্যিক তৎপরতা হয়েছে। টাকার বিনিময়ে ভর্তি নিশ্চিত করবার জন্য প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ বিভিন্ন পথ অবলম্বন করা হয়েছে।’
এছাড়াও প্রতিবেদনটি মোটে ১১টি সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটির সদস্যরা। এর মধ্যে তাৎক্ষণিক সুপারিশ তিনটি ও সামগ্রিক ভবিষ্যতের সকল ভর্তি পরীক্ষা দূষণমুক্ত স্বচ্ছ গ্রহণযোগ্য করা ব্যবস্থার জন্য ৮টি সুপারিশ করেছে ওই তদন্ত কমিটি।
এর মধ্যে তাৎক্ষণিক সুপারিশসমহূ হলো- ‘অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় এই বছরের মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষা তার নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি হারিয়েছে। আমরা বাধ্য হচ্ছি এই ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে নতুনভাবে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের সুপারিশ করতে।’
‘সরকার থেকে একটি স্বাধীন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করে দোষী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে তাদের শাস্তি বিধান করতে হবে।’
ও ‘সরকার উদ্যোগী না হলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে স্বপ্রণোদিত হয়ে এই বিষয়ে তদন্ত পরিচালনা করে সেই অনুযায়ী সরকারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবার জন্য কমিটি সুপারিশ করছে।’
সামগ্রিক ভবিষ্যতের সুপারিশসমূহ হলো- ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্ব চিকিৎসক শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি ‘মেডিকেল শিক্ষা কমিশন’ গঠন করা, গণপরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রকাশ ও প্রচার নিয়ন্ত্রণে নতুন বিধি/প্রবিধান প্রণয়ন করা সেই সঙ্গে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন-১৯৮০ ও অপরাধী ধরতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬ প্রয়োগ নিশ্চিত করা ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের পরীক্ষায় একটি সমন্বিত পদ্ধতি অনুসরণ করা।
এছাড়াও কোনো শিক্ষক শিক্ষকতার পাশাপাশি কোচিং সেন্টারের জড়িত আছে, তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া, কোচিং বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা, পরীক্ষায় অনিয়ম বা প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তদন্ত করে তা ফলাফল প্রকাশ করা এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত স্বাধীন একটি ‘শিক্ষা অধিকার কমিশন’ গঠন করতে হবে।
এমএইচ/এসএইচএস/আরআইপি