বাংলা গানের বেড়ে ওঠার গল্পে অ্যালবাম করেছি (ভিডিও)
অর্ক মুখোপাধ্যায়। ওপার বাংলার জনপ্রিয় গায়ক। বলা চলে বাংলা গানে এ প্রজন্মের বিস্ময় তিনি। তারুণ্যে উদ্দীপ্ত অর্ক যেমন প্রাণে ধরেছেন গানের ধ্রুপদি, তেমনি মজেছেন লোক, সুফি ও আধুনিক গানে। উপমহাদেশের নানা আঞ্চলের ভাষার গান নিয়ে তার বসবাস। আফ্রিকান, ইউরোপিয়ান, আমেরিকান ও মধ্য প্রাচ্যের সুর-তাল-লয়েও তিনি বেশ সাবলীল।
হাসিখুশি দিলখোলা অর্ক বাদ্যের তালে গানের আসরে বদলে যান ভিন্ন মানুষে। তিনি গিটার হাতে নিমিষেই ভ্রমণ করেন ঢাকা থেকে প্যারিস; প্যারিস থেকে আফ্রিকার কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চল হয়ে মিশর পেরিয়ে ফিরে আসেন কলকাতায়। এক গানে তার বহুরুপি গায়কি। এটাই অর্ককে ভিন্নতা দিয়েছে, নিজস্ব পরিচয় দিয়েছে।
সম্প্রতি তিনি মাছরাঙা টেলিভিশন ও সান ইভেন্টেস`র নিমন্ত্রণে অতিথি হয়ে গাইতে এসেছিলেন ঢাকায়। লোকজ গানের মূর্ছনায় তিনি ১২ নভেম্বর মাতিয়ে গেলেন লোক গান নিয়ে প্রথমবারের মতো আয়োজিত লোকসংগীত উৎসবে। উৎসেবর এক ফাঁকে শ্রোতাপ্রিয় এই তরুণ সাধক শিল্পী কথা বলেন জাগো নিউজের সাথে।
জাগো নিউজ : এ নিয়ে কতোবার এলেন বাংলাদেশে?
অর্ক : বিশবারেরও বেশি। এই দেশ, এই ঢাকা এখন আমার কাছে পড়শিবাড়ির মতো। গেল দুই বছর ধরে নিয়মিতই আসা হচ্ছে গান করতে। এখানে আমার অনেক প্রিয় মানুষ আছেন, বন্ধু আছেন।
জাগো নিউজ : গান গাইবার সময় মঞ্চে তো আপনাকে একেবারে ক্ষ্যাপাটে দেখায়। এই গায়কি কীভাবে রপ্ত করলেন?
অর্ক : এটা আসলে আমার গানেরই ধরণ। চর্চার বিষয়। তবে গানে এটা হয় অনুভূতির জায়গা থেকে। আর যখন আপনি দর্শকের সামনে বসে কিছু করবেন তখন বাড়তি একটা উন্মাদনা তো থাকেই। আমরা যারা সরাসরি মঞ্চে বসে গান করি তাদের কাছে দর্শকও একটা এনার্জি।
জাগো নিউজ : আপনাকে এই উৎসবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে অর্ক মুখার্জি এন্ড কালেক্টিভ। আমরা তো জানি আপনার ব্যান্ডের নাম ‘ফিডলার’স গ্রিন’। তবে এই কালেক্টিভ ব্যাপারটি কী?
অর্ক : কালেক্টিভ বলতে এখানে মিন করা হয়েছে বিশ্বায়নের এই যুগে সংগীতের পৃথিবীটাও একটা পরিবারের মতো। এখানে একজন শিল্পীর একটা গান যা ডিমান্ড করছে তা পূরণের জন্য সেই শিল্পী বিশ্বের যে কোনো দেশ থেকে যে কোনো বাদ্য, বাদক, গায়ক, গায়িকা সঙ্গে নিতে পারেন। অর্থাৎ প্যারিসে হয়তো একজন খুব ভালো বেহালাবাদক আছেন। যদি মনে করি আমার একটা গানের জন্য তাকে প্রয়োজন আমি অবশ্যই তাকে আমার মঞ্চে আনবো। সংগীতের চর্চা এখন উন্মুক্ত। আমি যখন ঢাকায় আসি তখন পরিকল্পনা করেছি কী ধরনের গান করবো। সেই ধরনের গান করতে আমার কী ধরনের বাদ্য লাগবে এবং সেগুলো বাজাতে আমার কার সাপোর্ট লাগবে। সে ভাবনা থেকেই সামিক চ্যাটার্জি, ঋতবান দাস, অর্ক দীপ্তাংশু রায়কে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। আমরা কোনো ব্যান্ড নই, একটি প্রজেক্ট। আমি যেহেতু ১৯টা ভাষায় গান করি, বিভিন্ন দেশে গান করি তাই বিভিন্ন দেশের সংগীত সম্পর্কে আমাকে জানতে হয়েছে।
জাগো নিউজ : একটু পিছন ফিরে যাই। গানের সাথে আপনার সম্পর্কের শুরুটা কীভাবে?
অর্ক : আসলে আমার জন্ম ও বেড় ওঠাটাই গানের সাথে। জন্মেই পেয়েছি গানের আবহে আচ্ছন্ন একটা পরিবার। আমার দাদা ও নানাবাড়ি উভয়েই গানের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৭১ সালে তারা বাংলাদেশ ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। আমার মা বরিশাল থেকে রিফিউজি হয়ে দেশ ছাড়েন। আর আমার বাবার অঞ্চল ছিলো বিক্রমপুর। তারা যাবার সময় অনেক কিছুর সাথে গানকেও এখান থেকে প্রাণে করে নিয়ে গেছেন।
জাগো নিউজ : আরেকটু বুঝিয়ে বলুন.....
অর্ক : পূর্ববঙ্গ অঞ্চলের প্রচলিত লোকসাহিত্যকে একত্রে পূর্ববঙ্গ গীতিকা বলা হয়। যার একটি অংশ ময়মনসিংহ গীতিকা। এই গীতিকার সংকলক ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক আমার দাদীর বাবা। এটিকে আপনাদের বর্তমান বাংলাদেশের লোকগানের সবচেয়েং বড় সম্পদ বলে আখ্যা করা হয়। তো আমার পরিবারে গানের একটা পরিবেশ আগে থেকেই তৈরি হয়েছিলো। তবে আমাকে গানের সাথে সম্পর্কটা করিয়েছেন আমার বাবা ও মা-ই। আমার মা নজরুল সংগীতের শিল্পী ছিলেন। আর বাবাকে দেখেছি নানা ধরণের গানই গাইতে। তাদের কাছ থেকেই গানের সা রে গা মা শেখা। পরবর্তীতে বড় হতে হতে গান শুনতে শুনতে নিজেকে পরিণত করেছি। গানে নিজের ট্র্যাক বেছে নিয়েছি। চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে একসময় বিশ্ব সংগীতের প্রতি আগ্রহী হই। নানা দেশের নানা সুর আমাকে প্রভাবিত করেছে, বিভিন্ন দেশের কবিয়াল-গীতিকবিদের গান ও শিল্পীদের গায়কী আমাকে মুগ্ধ করেছে।
জাগো নিউজ : গানের প্রায় সব ধারাতেই আপনার উপস্থিতি আছে। কিন্তু নিজেকে ফোক ও সুফি গানের শিল্পী হিসেবেই পরিচিত করেন কেন?
অর্ক : ব্যাপারটি ঠিক তা নয়। সব গান গাইতেই আমার ভালো লাগে। তবে ফোক গানে একটা অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। প্রথমে ক্ল্যাসিক দিয়ে শুরু করলেও একটা সময় বাউল গান আমাকে খুব প্রভাবিত করে। এছাড়া গানের এই ধারা বিশেষ করে ফোক-ফিউশনেই বিশ্ব জুড়ে সংগীতের একটা ইউনিটি আছে।
জাগো নিউজ : খুব পরিচিত একটা বাংলা গানও যখন আপনি গান সেখানে বিদেশি সুর ও তালের ব্যাবহার দেখা যায়। এ বিষয়ে জানতে চাই....
অর্ক : ওই যে বললাম, এটা চর্চার বিষয়। আমি অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করে আসছি। বিশ্ব সংগীতের ভাবনায় আপনি চাইলে এবং পারলে যে কোনো দেশের গানই গাইতে পারেন। মানুষের মতো গানের কোনো দেশ নেই। তাই তার আসা যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট বা ভিসা কিছুই লাগে না। শিল্পী রপ্ত করতে পারলে সবই পারেন। আমার কাছে সুর বা গানটাই মূখ্য। সেটা যে কোনো দেশের হতে পারে, ভাষার হতে পারে। তবে একজন বাঙালি হিসেবে আমার লক্ষ বাংলা গানকে বিশ্বায়ন করা।
জাগো নিউজ : আপনার পড়াশোনাও কী সংগীত নিয়ে?
অর্ক : আসলে গান আমি গাইতে খুব একটা পারি বলে মনে করি না। আমি যেটা পারি সেটা হলো পড়াশোনা করতে। গেল সাত বছর ধরেই আমি নিয়মিত ছাত্রের মতো বিশ্বের নানা ধরণের সংগীত নিয়ে পড়াশোনা করেছি, করছি এখনো। তবে আমার একাডেমিক পড়াশোনা ছিলো চলচ্চিত্র নিয়ে। মূলত চলচ্চিত্র নিয়ে পড়তে গিয়েই বিশ্ব সংগীতের প্রতি ঝোঁকটা বেড়েছে।
জাগো নিউজ : ঢাকায় প্রথমবারের মতো আয়োজিত লোকসংগীত উৎসব সম্পর্কে কিছু বলুন?
অর্ক : আমি সারা বিশ্বের নানা প্রান্তে অন্তত ২৪টা বিশ্ব সংগীতের আসরে বাজিয়েছি। কলকাতাতে নিজে অনেক আসর আয়োজন করেছি। ভারতবর্ষেও দেখেছি অনেক বড় বড় গানের আয়োজন। কিন্তু এমন বিশাল আয়োজন, এত লোক সমাগম, শৃঙ্খল আর মনযোগী শ্রোতা দেখিনি। ৬০ হাজার মানুষের সামনে বসে গান গাইবার অভিজ্ঞতা বিশ্বব্যাপি খুব বেশি শিল্পীর ভাগ্যে জুটে না। আমি সেই সৌভাগ্যবান হতে পেরে আনন্দিত, গর্বিত। এই উৎসবের আয়োজকদের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা তারা আমাকে এমন মহা আয়োজনে গাইবার মতো যোগ্য মনে করেছেন, নিমন্ত্রণ করেছেন। এ উৎসবের সবচেয়ে যে দিকটি ভালো লেগেছে তা হলো দর্শকদের ফ্রি গান শোনার ব্যাপারটি। দেখুন, টাকা ছাড়া শিল্পীর টিকে থাকা কষ্টদায়ক। তবু সবসময় মানুষ হাজার হাজার টাকা খরচ করে গান শুনতে আসতে চাইবেন না। মাঝেমধ্যে তাদের জন্য ফ্রি কিছু বিনোদনের ব্যবস্থা শিল্প সংস্কৃতির স্বার্থে রাখতে পারলে খুব ভালো হয়। এখানে সেটিই হয়েছে। আয়োজকদের প্রশংসা করতেই হবে। এই ধরনের উৎসব শ্রোতাদের গান শুনতে অভ্যাস করায়। এই উৎসব বারবার হোক।
জাগো নিউজ : প্রায় তিন বছর আগে ‘ঘাটের কথা’ নামে আপনাদের প্রথম অ্যালবাম বাজারে আসে। আবার কবে নাগাদ.....
অর্ক : এই মাসেই আসছে। আগামী ২০ নভেম্বর কলকাতায় আমাদের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘ফাইভ’ প্রকাশ হচ্ছে। ইচ্ছে আছে প্রথমটির মতো দ্বিতীয় অ্যালবামটিও বাংলাদেশে প্রকাশ করবো। তবে https://www.oklisten.com এই লিংকে গিয়ে ডিজিটাললি বিশ্বের যে কেউ অ্যালবামটি কিনে গান শুনতে পারবেন।
জাগো নিউজ : নতুন অ্যালবামটি নিয়ে কিছু বলুন?
অর্ক : বাংলা গানকে একটা ইমিগ্রেশানের মাধ্যমে বিশ্বায়নে নিয়ে যাবার অনুপ্রেরণায় গেল ছয় মাস ধরে এই অ্যালবামটির কাজ করেছি। এখানে বাংলা গান নিয়ে ফিউশন হয়েছে, বাংলা গান কীভাবে বেড়ে ওঠেছে সেই গল্পটাও বলা হয়েছে। পাঁচটি কোলাবরেশানে বিশ্বের নানা অঞ্চলের পাঁচ ধরনের ফোক সংগীতে গান তৈরি করেছি। তার মধ্যে আছে আমাদের গঙ্গার চারধারে বহমান পরিচিত সুর। আছে ফ্রান্সের সংগীতের মেজাজে যাযাবর জীবন যাপনের এতিহ্যবাহী বেদে সম্প্রদায়ের সুররীতির গান। থাকছে পশ্চিমা বিশ্বের সংগীতের আবহে আইরিশ সুর, আফ্রিকান উপজাতিদের সুর। সেইসাথে এশিয়ার মধ্য ও পূর্ব অঞ্চলের সুরের ব্যবহারও করেছি। তারমধ্যে পারস্যের সুর-তালের আমেজও পাবেন শ্রোতারা। অ্যালবামে মোট দশটি গান থাকছে। তারমধ্যে ‘পাল উড়াইয়া দে’, ‘আগে জানলে’, ‘কালিয়া’, ‘মানুষ মরলে পরে’, ‘কত দিনে’ ‘রেশম ফিরিরি’ গানগুলো উল্লেখযোগ্য।
জাগো নিউজ : ঢাকার মতো কলকাতাতেও অর্ণবের একটা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তার সাথে আপনার সম্পর্কটা কেমন?
অর্ক : খুব ভালো। অর্ণব আমার নয় বছরের পুরোনো বন্ধু। আমরা একসাথে অনেক কাজ করেছি। আর ব্যক্তি অর্ণবের ক্ষেত্রে যেটা বলবো- ও খুব সেনসিটিভ এবং রুচিশীল একজন শিল্পী। মিউজিক নিয়ে ওর ফিউশন অসাধারণ। আর মূলত ও রবি ঠাকুরের ভক্ত-অনরাগী হলেও ফোক গানেও অর্ণবের মুন্সিয়ানা আছে; মুগ্ধ করে। বিশেষ করে আমি ওকে ধন্যবাদ দেই এজন্য যে- আপনার এখানে আজকের প্রজন্মের কাছে লোকসংগীতকে প্রচারের দায়িত্ব যারা যারা নিয়েছেন অর্ণব তাদের অন্যতম একজন। আশা করি ভবিষ্যতেও অর্ণবের সাথে সুন্দর বন্ধুত্বটা থাকবে।
জাগো নিউজ : আপনার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই....
অর্ক : আমার বাবার নাম দেবাশীষ মুখোপাধ্যায় মায়ের নাম অপর্ণা মুখোপাধ্যায়। আমার এক দিদি আছেন। তিনি আমেরিকার টেক্সাসে ক্যান্সার রিসার্চ নিয়ে পড়াশোনা করছেন। কলকাতায় আমি বাবা, মা আর ঠাকুর মাকে (দাদী) নিয়ে একসাথে থাকি। আমার দাদু মারা গেছেন।
জাগো নিউজ : অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। আবারো আসবেন, আবারো দেখা হবে এমনই কোনো এক গানের আসরে.....
অর্ক : আপনাকেও ধন্যবাদ। সেইসাথে বাংলাদেশের গান পাগল মানুষদের জন্য অনেক ভালোবাসা রইল। সবাই ভালো থাকবেন। বাংলা গান শুনবেন।
দেখুন ঢাকা লোকসংগীত উৎসবে অর্ক মুখার্জির গাওয়া একটি গান :
এলএ/আরআইপি