নতুন ঠিকানায় পুরনো কারাগার
রাজধানীর অদূরে কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরে নির্মিত হয়েছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। আগামী ১৫ নভেম্বরের পর যেকোনো দিন আনুষ্ঠানিকভাবে এটি উদ্বোধন করা হবে। কেমন হবে নতুন এ কারাগারটি তা নিয়ে থাকছে জাগো নিউজের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ থাকছে এর প্রথম পর্ব।
ঢাকা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটারের দূরত্বে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের রাজেন্দ্রপুর বাসস্ট্যান্ড। বাস থেকে নামতেই চোখে পরে দৃষ্টিনন্দন কয়েকটি ভবন। দেয়ালের রং লাল নয়, সাদা। দূর থেকে দেখে মনে হবে কলোনি কিংবা কোনো মেগাসিটি।
পিচঢালা পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভবনগুলোর কাছে যেতে সময় লাগলো ২০ মিনিট। এগুলোতে প্রবেশের আগেই একটি বড় গেট। গেটে নেই কোনো নামফলক। তবে ৪০ ফিট উচ্চতার ওয়াচ টাওয়ার, আর ২৫ ফিটের সীমানা প্রাচীর দেখে বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল না যে কাদের জন্য তৈরি হচ্ছে এটি। পুরনো কয়েদি, জেলার আর আসামিদের নিয়ে এটিই হতে যাচ্ছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নতুন ঠিকানা।
পুরনো কারাগারের সঙ্গে দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। তবে কারাগারের ভবনগুলোর নিখুঁত ও দৃষ্টিনন্দন শৈলী, কাঠামো আর পরিবেশ বিবেচনায় এটি ১২ গুন এগিয়ে। কারাগারে প্রবেশের পরই দেখা গেল, প্রচণ্ড রোদে এখনো নির্মাণের কাজ করছেন শ্রমিকরা। অনেকে ভেতরে টাইলস আর মোজাইকের কাজ করছেন। মালিরা গাছের চারা লাগাচ্ছেন, আবার পানিও ঢালছেন। কেউ ইটের উপর ইট গাঁথছেন। কেউবা ভবনে রং লাগানোর কাজে ব্যস্ত। কারাগারটিতে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।
সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ১৫ নভেম্বরের পর যেকোনো দিন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে এই কারাগারের কার্যক্রম। রাজেন্দ্রপুরে প্রায় ১৯৪ একর জায়গার উপর নির্মিত হয়েছে এশিয়ার সর্বাধুনিক ও বৃহত্তম এই ‘মডেল’ কারাগারটি। এর ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৫ হাজার পুরুষ। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় ৮ হাজার পর্যন্ত আসামি থাকতে পারবেন এখানে।
নভেম্বরের মধ্যে সম্পূর্ণ কারাগারের কাজ শেষ না হলেও প্রায় ৯৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে পরিচ্ছন্নতা আর ফিনিশিংয়ের কাজ। পরিচ্ছন্নকর্মী জামাল বললেন, কয়েকদিনের মধ্যেই শেষ হবে পরিচ্ছন্নতার কাজ।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেল, কারাগারটির প্রধান গেটের উপরেই প্রশাসনিক ভবন। প্রধান গেট দিয়ে প্রবেশের পরই বাম পাশে আছে জেল স্কুল ও লাইব্রেরি। এর সামনেই রয়েছে মানসিক ভারসাম্যহীন ও প্রতিবন্ধীদের কারাগার, কারারক্ষী হাউস ও মেডিকেল ইউনিট। এরপরে পাশাপাশি তিনটি ছয় তলা ভবন। এগুলো বিচারাধীন বন্দিদের জন্য। এসব আসামিদের জন্য এই কারাগারে মোট ৬টি ভবন রয়েছে। তিনটি ভবনের পর রয়েছে ডেনজার প্রিজন-২ এবং ৪।
প্রধান গেটের ডান পাশে প্রথমেই কিশোর বন্দিদের ভবন, এর দক্ষিণে শ্রেণিভিত্তিক বা ক্লাসিফাইড (ভিআইপি) বন্দি ভবন, এরপরের তিনটি ৬ তলা ভবন বিচারাধীন বন্দিদের জন্য, পরের ভবন দুটি ডেনজার প্রিজন-১ এবং ৩। ডেনজার প্রিজন-৩ এর দক্ষিণ পাশেই রয়েছে ফাঁসির মঞ্চ।
গেট দিয়ে প্রবেশ করে সোজা আনুমানিক আড়াইশ’ গজ দূরে গোলাকার একটা খোলা বৈঠকখানার মতো করা হয়েছে। এটার নাম কেইস টেবিল। এটি কারা অভ্যন্তরের নানা ঘটনার সালিশ বৈঠকের স্থান। এর পশ্চিমেই রয়েছে গুদাম, ময়দার কল, ধোপাখানা, লন্ড্রি ও সেলুনের ঘর।
কারাগারের বাইরে বাম দিকে রয়েছে দর্শনার্থীদের সঙ্গে আসামির দেখা করার ঘর। এছাড়াও রয়েছে কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবারের জন্য আলাদা ভবন, অফিসার্স ক্লাব, স্টাফ ক্লাব, স্কুল, মসজিদ, মিলনায়তন আর কারারক্ষীদের থাকার জন্য ব্যারাক।
জমি অধিগ্রহণ, ভরাটসহ আধুনিক এই কারাগারটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৪০৬ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে পুরুষ কারাগারের পাশে আলাদাভাবে একটি মহিলা কারাগার নির্মাণ করা হবে। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেল, ইতিমধ্যে মহিলা কারাগার নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। চলছে পুরো দমে। তবে এটি পুরুষ কারাগারের সীমানা প্রাচীরের বাইরে।
কারা সূত্র জানায়, ১৯৮০ সালের দিকে কারাগারের আশপাশে বেশ কয়েকটি বড় বড় আবাসিক ভবন গড়ে ওঠে। এতে কারাগারের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা উভয়ই বিঘ্নিত হচ্ছে বলে উপলব্ধি করে তৎকালীন সরকার। তাই একই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত কাউন্সিলের একটি সভায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সরানোর বিষয়টি প্রথম উঠে আসে। ১৯৯৪ সালে একে চূড়ান্তভাবে সরিয়ে দুটি কারাগার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর মধ্যে একটি গাজীপুরের কাশিমপুর ও অন্যটি কেরানীগঞ্জের।
অবশেষে ২০০৬ সালে একনেকে এ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়ার হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় জমি অধিগ্রহণের কাজ। বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয় ২০১১ সালের জুন মাস পর্যন্ত। কিন্তু পরে তিন দফায় প্রকল্প মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ২০১৭ সাল পর্যন্ত। ২০০৭ সালে কারা এলাকায় মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়। মূল কারাগার ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১১ সালে।
এআর/এসএইচএস/আরআইপি