মমতাজের সুরে মাতোয়ারা লোকসংগীত উৎসব


প্রকাশিত: ০৭:৪০ পিএম, ১৩ নভেম্বর ২০১৫
ছবি : লয়েড তুহিন হালদার

বাউল সম্রাজ্ঞী মমতাজের সুরে মাতোয়ারা মধ্যরাতের লোকসংগীতের উৎসব। শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় তিনি মঞ্চে আসেন মনপুরা চলচ্চিত্রের ‘আগে যদি জানতাম বন্ধু’ গান নিয়ে। এরপর তিনি রবীন্দ্রসংগীত, পালাগানসহ বেশ কিছু জনপ্রিয় গান পরিবেশন করেন। তার গানের পর মঞ্চে আসে চীনের ইউনান আর্ট ট্রুপ। তাদের পরিবেশনা দিয়েই শেষ হয় তিন দিনব্যাপি এ উৎসবের দ্বিতীয় দিন।

এর আগে ‘বসুন্ধরার বুকে এই বরষারি ধারা’, তোমার দিল কি দয়া হয় না’ চঞ্চল মন আমার শোনে না কথা, -এ ধরনের কথার গানে গানে ঝড় তুলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত বাউল পবন দাস বাউল। মঞ্চ থেকে ভেসে আসা পবন দাস বাউলের সুরের যাদু আর আর্মি স্টেডিয়ামের মাঠের সকল দর্শক শ্রোতাদের মাঝে ছিল নৃত্যের উন্মাদনা। থেকে থেকে করতালি আর নাচের উন্মাদনার মধ্য দিয়ে কাঙ্খিত এই শিল্পীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন দর্শক শ্রোতারা। যে শিল্পীর জন্য সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা সেই শিল্পীর কণ্ঠের যাদুতে ভক্তদের উন্মাদনার মাত্রাটা একটু বেশী-ই-থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

ষাট হাজার দর্শক শ্রোতাদেরকে সুরের মূর্চ্ছনায় দোলায়িত করছিলেন উপমহাদেশের বিখ্যাত এই বাউল। গানের ব্যাকরণ জানে না দর্শক শ্রোতারা, বোঝে না সারগাম, উদারা, মুদারা, তারা। জানে না তাল, লয়, মান, মাত্রা, সমফাঁক, রাগ আর খেয়ালের খেলা। জানে শুধু সুরের লহরীতে উন্মাদ হতে। সুরের সুধায় উন্মাদ হওয়ার আগ্রহ বাঙালির চিরন্তন। রক, জ্যাজ, ব্লুজ, হিপহপের উন্মাদনা যখন সারাবিশ্বকে কাঁপিয়ে তুলছে ঠিক তখনই রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে নিজের গানে নিজেকে খুঁজে ফেরার পালা। মাটির সুরে, প্রাণের সুরের খেয়ালে অবগাহিত হওয়ার অঘোষিত প্রতিযোগিতা। শেকড়ের টানে, নাড়ির টানের ভালোবাসা আর আনন্দের চেয়ে আর কোন ভালোবাসা আর আনন্দ উচ্ছাস থাকতে পারে না। আর পবন দাস বাউল মঞ্চে আসার পর সেই উল্লাসের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়।

মাছরাঙা টেলিভিশন ও সান ইভেন্টসের আয়োজনে শুরু হওয়া রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামের তিনরাতের ‘ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট, আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসব ২০১৫’-এর দ্বিতীয় রাতের আসরে দর্শক শ্রোতা তথা সংগীতপ্রেমীদের উচ্ছাস, উল্লাস আর উন্মাদনায় এমনটাই লক্ষ্য করা গেছে।

সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে বিকেল থেকেই ছিল দর্শক শ্রোতাদের উপচেপড়া ভীড়। সংগীতের সুধায় স্নাত হতে সুশৃঙ্খল ও সারিবদ্ধভাবে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতেও সংগীতানুরাগীদের মাঝে কোন ধরনের বিরক্তির ছাপ লক্ষ্য করা যায়নি। সংগীতের মহাসমুদ্রে ঝাঁপ দেয়ার প্রত্যয় ছিল সমগ্র আর্মি স্টেডিয়ামের দর্শক শ্রোতাদের  চোখে-মুখে। সন্ধ্যায় প্রায় ৩৫ হাজার দর্শক থাকলেও মধ্যরাতে দাঁড়ায় তা প্রায় ষাট হাজারে। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার প্রাণবন্ত উপস্থিতিতে এক মহামিলন মেলায় পরিণত হয়েছিল লোকসংগীতের এই আসর।

পবন দাস বাউলের পরিবেশনা শেষে মঞ্চে আসেন বাংলার ফোক সম্রাজ্ঞী খ্যাত শিল্পী মমতাজ। ‘ফাইট্টা যায় বুকটা ফাইট্টা যায়’সহ তার জনপ্রিয় গানগুলো পরিবেশন করতে ভুললেন না। ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট ২০১৫ এর দ্বিতীয় দিনের সর্বশেষ পরিবেশনা ছিল চীনের ইউনান আর্ট ট্রুপের। তাদের নিজস্ব যন্ত্র হুলুসি (এক ধরনের বাঁশি) বাজিয়ে দর্শকদের ভিন্ন এক সংগীতের স্বাদ দেন তারা। তখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে।

কুষ্টিয়ার বাউল ভজন ক্ষ্যাপার দরাজ কণ্ঠের সুর। ‘গুরু গো এ ভব কারাকার, করিতে পারাবার, তুমি গুরু আমার পাড়ের কান্ডারি’ কাওয়ালিধারার এই গানটির মধ্য দিয়ে শিল্পী তার পরিবেশনা শুরু করেন। যাদুকরি কণ্ঠে এই শিল্পীর পরিবেশনায় সুরের বারিতে সিক্ত হতে থাকেন সংগীতসমজদাররা।

ভজন ক্ষ্যাপার পরিবেশনার মধ্য দিয়েই শুরু হয় দ্বিতীয় রাতের আয়োজন। একে একে তিনি পরিবেশন করেন ‘ও মন রে কেন ডুব দিলে না পাক-দরিয়ায়’সহ বেশ কয়েকটি গান। এরপর মঞ্চে পরিবেশনা নিয়ে আসেন আয়েশা জেবীন দিপা, বিউটি খাতুন, দিতি সরকার, মরিয়ম আখতার কণা ও মাসুমা সুলতানা সাথী। তারা পরিবেশন করেন ‘কি দিয়ে জুড়াই বলো সখী’, বাউলসাধক শাহ আবদুল করিমের বিখ্যাত গান ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইছে/কেমন দেখা যায়/আরে ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপক্সক্ষী নাও’,‘করিমনা কাম ছাড়ে না মদনে, ‘সোনা বন্ধুরে আমি তোমার নাম লইয়া কান্দি’, ‘সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী’ ইত্যাদি।

এর আগে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে দ্বিতীয় রাতের আসরের উদ্বোধন করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। এ সময় বিশেষ অতিথি ছিলেন ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরন।

শনিবার দিবাগত রাতে শেষ হবে তিনরাতের এই ফোক ফেস্টিভ্যাল। উপমহাদেশের প্রখ্যাত বাউল শিল্পী পবন দাস বাউল ও বাউল সম্রাজ্ঞী মমতাজ ছাড়াও উৎসবের দ্বিতীয় দিনে গান পরিবেশন করেন আব্দুল আলীমের তিন সন্তান আজগর আলীম, জহির আলীম, নুরজাহান আলীম, মমতাজ, অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডস, ইউনান আর্ট ট্রুপ ও বারী সিদ্দিকী।

এলএ/আরএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।