কে এই অনুপ চেটিয়া
ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা) দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের স্বাধীনতার লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে আসছে। ১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল আরও কয়েকজনকে নিয়ে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন অনুপ চেটিয়া। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক তিনি।
তখন থেকে উলফা আসামের স্বাধীনতার জন্য ব্যাপক সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সশস্ত্র কর্মকাণ্ড চালানোর এক পর্যায়ে ভারত সরকার অনুপ চেটিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। অপহরণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ছাড়াও তার বিরুদ্ধে একাধিক খুনের অভিযোগ আনে ভারত সরকার। ১৯৯১ সালে অনুপ চোটিয়াকে গ্রেফতারও করে আসাম সরকার। কিন্তু কিছু দিন পরই জামিন পেয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন তিনি।
দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকার পর ১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডের একটি বাসা থেকে দুই সঙ্গীসহ গ্রেফতার হন অনুপ চেটিয়া। ওই সময় তার কাছ থেকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট, স্যাটেলাইট টেলিফোন ও বেশ কিছু বৈদেশিক মুদ্রা উদ্ধার করা হয়। ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি অনুপ চেটিয়ার বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় প্রথম বৈদেশিক মুদ্রা আইনে একটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। পরে পাসপোর্ট ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে আরও দুটি মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। এসব মামলায় আদালত তার বিরুদ্ধে জরিমানাসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন।
এদিকে গ্রেফতারের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তরের জন্য ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ দেয়া হয়। তবে ২০০৩ সালের ২৩ আগস্ট হাইকোর্টে বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করায় হস্তান্তর নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। আইনি জটিলতা ও দুই দেশের মধ্যে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি না থাকার কথাও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতকে বলা হয়েছিল। তবে বর্তমান সরকার আমলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তরে জটিলতা নিরসন হয়। বুধবার উলফার শীর্ষ নেতা অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তরের মাধ্যমে শেষ হল দেড় যুগের বিতর্ক।
১৯৬৭ সালে আসামের তিনসুকিয়ার জেরাইগাঁ গ্রামে জন্ম অনুপের। তার স্ত্রীর নাম মনিকা চেটিয়া। অনুপ চেটিয়া নামে ব্যাপক পরিচিত হলেও তার আসল নাম গোলাপ বরুয়া। আরও কিছু ছদ্মনাম আছে অনুপের- কখনও তিনি সুনীল বরুয়া, কখনও ভাইজান, আবার কোথাও কোথাও তিনি পরিচয় দিতেন আহমদ নামে।
জানা গেছে, গ্রেফতারের পর তিনটি মামলার মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা রাখার মামলায় তিন বছর, অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে চার বছর ও স্যাটেলাইট ফোন রাখার মামলায় ৭ বছর সাজা হয়। একই সঙ্গে ১১ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে দেড় বছর কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। সে হিসেবে অনুপ চেটিয়ার প্রথম পর্যায়ে কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ হয় ২০০৩ সালের ২৫ আগস্ট। তবে জরিমানার অর্থ পরিশোধ না করায় আরও দেড় বছর কারাদণ্ড ভোগ করেন অনুপ চেটিয়া। সে হিসেবে তার কারাদণ্ডের মেয়াদ ছিল ২০০৭ সালের ২৫ ফেব্রয়ারি পর্যন্ত।
সূত্র বলেছে, কারাবিধি (জেলকোড) অনুযায়ী যে তারিখ থেকে আসামি গ্রেফতার হয় ওই তারিখ থেকে সাজা কার্যকর হয় এবং একই সময় একাধিক মামলায় সাজা থাকলে সেগুলো এক সঙ্গে কার্যকর হয়। সে হিসেবে অনুপ চেটিয়ার সর্বোচ্চ সাত বছর সাজা ভোগের মাধ্যমে মামলার সাজাই কার্যকর হয়েছে।
তবে সাজার মেয়াদ শেষ হলেও সে সময় মুক্তি না দেয়ার জন্য অনুপ চেটিয়ার পক্ষে হাইকোর্টে রিট করে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা। ওই সময় রিট আবেদনে বলা হয়, ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হলে অনুপ চেটিয়ার জীবন শংকার মধ্যে পড়তে পারে। ওই রিট আবেদনে মুক্তি দেয়া হলে ভারত সরকারের কাছে হস্তান্তর না করে বাংলাদেশ থেকে অন্য গন্তব্যে যাওয়ার সুযোগ চান অনুপ চেটিয়া। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়া যাবে না মর্মে নির্দেশ দেন।
সূত্র জানায়, এর আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতারের পর ২০০৯ সালের শেষ দিকে উলফার চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়াসহ সংগঠনের শীর্ষ বেশ কয়েকজন নেতাকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পুশব্যাকের মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়। এরপর ২০১০ সাল থেকে দিল্লিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে উলফার শান্তি আলোচনা চলছে। এমন অবস্থায় অনুপ চেটিয়া ২০১৩ সালের ১৩ মে একবার ভারতে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশ সরকারের কাছে ওই চিঠি পাঠান। এর মাত্র দুই মাসের মাথায় ২০১৩ সালের ২৩ আগস্ট অনুপ চেটিয়া বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন। আর ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অনুপ চেটিয়ার মুক্তি নিয়ে নতুন করে জটিলতা দেখা দেয়।
কারা সূত্রে জানা গেছে, সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে অনুপ চেটিয়া রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন। এরপর ২০১৪ সালে তাকে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ২০১৪ সালের ২১ আগস্ট কাশিমপুর কারাগার থেকে আবারও তিনি ভারতে ফেরার আগ্রহ জানিয়েছিলেন। তার ওই আগ্রহ প্রকাশের পর ২০১৪ সালের ১৯ আগস্ট গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের কনস্যুলার জেপি সিং দেখা করেন। এর এক বছর পর বুধবার অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হল।
এসএইচএস/আরআইপি