বিজেপির ‘লাভ জিহাদ আইন’র আড়ালে কী?
সিএএ, এনআরসি’র পর এবার কথিত ‘লাভ জিহাদ’ বন্ধে নতুন আইন এনেছে ভারত সরকার। কট্টর হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির প্রণীত এ আইন ‘মুসলিমবিরোধী অ্যাজেন্ডা’ থেকেই উদ্ভূত বলে মনে করছেন সুধীজনরা। মানবাধিকার কর্মীরা আইনটির সমালোচনায় সরব হলেও এক্ষেত্রে বিজেপির রাজনৈতিক প্রচারপত্রের ভূমিকা নিয়েছে কিছু কিছু সংবাদমাধ্যম।
নাগরিক সমাজের ধারণা, রাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ব্যর্থতার কারণে অনেক আগে থেকেই বিরোধীদের সমালোচনার মুখে রয়েছে মোদির সরকার। এর মধ্যে কৃষক বিদ্রোহ শুরু হলে এটিকে দমনে ধর্মের ব্যবহার করতে না পেরে একের পর এক বিজেপিশাসিত রাজ্যে কথিত ‘লাভ জিহাদবিরোধী আইন’ পাস করা হচ্ছে, যাতে মূল ব্যর্থতা আড়াল করা যায়।
পর্যবেক্ষকদের ভাষ্যে, ধর্ম নিয়ে বিজেপির অপরাজনীতির নজির সাম্প্রতিক সময়ে অনেক। এর মধ্যে কাশ্মীর দ্বিখণ্ডিত করা, বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ), জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) কিংবা অযোধ্যার বাবরি মসজিদের জায়গায় মন্দির তৈরির ভিত্তিপ্রস্তরসহ অসংখ্য মুসলিমবিরোধী পদক্ষেপ উল্লেখযোগ্য। এসবের বেশিরভাগই ইতোমধ্যেই কার্যকর করেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার।
তবে বিতর্কিত কৃষি আইনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি দেশটির লাখ লাখ কৃষক দিল্লি অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করার পর বেশ চাপে পড়েছে সরকার। তাই রাজ্যে রাজ্যে শুরু হয়েছে কথিত লাভ জিহাদবিরোধী আইন প্রণয়ন। এ বিষয়ে বিজেপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, হিন্দু ধর্মের তরুণীদের বিয়ের ফাঁদে ফেলে ধর্মান্তরিতকরণ বন্ধই আইনটির মূল উদ্দেশ্য।
কিন্তু আসলেই কি তাই? বিজেপির ধর্মীয় মেরুকরণের এই রাজনীতি প্রসঙ্গে ভিনধর্মী দম্পতিদের অভিমত নিয়ে
একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জার্মানিভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বিজেপির নেতৃত্বাধীন উত্তরপ্রদেশ সরকার ধর্মান্তরণের পর বিয়ে রোধ করতে অধ্যাদেশ জারি করেছে। অথচ ভিনধর্মে বিয়ে নতুন কোনো বিষয় নয়। সত্যিই কি এই সম্পর্কে প্রেম নেই, এর লক্ষ্য কেবল ধর্ম পরিবর্তন?
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে একসঙ্গে পড়তেন সাদিক জামান ও মানসী সিনহা। প্রেম থেকে পরিণয় ৪২ বছর আগে কলকাতার বাসিন্দা সাদিক ছিলেন সরকারি সংস্থার উচ্চ পদাধিকারী। পৃথক ধর্ম তাদের দাম্পত্য বা পারিবারিক সম্পর্কে ছাপ ফেলতে পারেনি। সেই সাদিক বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছে ‘লাভ জিহাদ’ শব্দবন্ধ শুনে বিস্মিত।
ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এ কোন ভারত? এটাও আমাদের দেখতে হচ্ছে। আমাদের দুই পরিবারই নাস্তিক। ধর্মীয় আচারকে ঘৃণা করি। আমার দুই ছেলেও সেটাই বিশ্বাস করে। আজ ভাবতে হচ্ছে, দেশে থাকতে পারব না হয়তো।’
বিজেপি সমর্থকদের একটি অংশ মুসলিম পাত্রের সঙ্গে হিন্দু পাত্রীর বিয়েতে ষড়যন্ত্র দেখছে। তাদের অভিযোগ, হিন্দু মেয়েদের সামনে ভালোবাসার ফাঁদ পেতে তাদের ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। এসব ফাঁদ এর লক্ষ্য হলো জিহাদি তৈরি করা; যারা ভারতের বিরুদ্ধে সক্রিয় হবে। এমন উদাহরণও দেখাবার চেষ্টা করছে বিজেপি নেতৃত্ব।
উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের বিজেপি সরকার এই প্রবণতা রোধে আদেশ জারি করেছে। চলতি সপ্তাহে নয়া আইনে প্রথম গ্রেফতার হয়েছেন রাজ্যের এক মুসলিম তরুণ। এই আইনে দোষী সাব্যস্ত হলে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এমন আইন পাস করার ঘোষণা দিয়েছে বিজেপিশাসিত অন্য রাজ্যগুলোও।
বিরোধীদের বক্তব্য, এটা বিজেপির একটি বিশেষ ধর্মের অনুসারীদের সমস্যায় ফেলার কৌশল। এ নিয়ে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে কথা বলেছে পশ্চিমবঙ্গে কয়েকজন দম্পতির সঙ্গে যারা ভিনধর্মে বিয়ে করেছেন।
তাদেরই একজন ভাষা ও চেতনা সমিতির প্রধান অধ্যাপক ইমানুল হক। তিনি ২৬ বছরের বিবাহিত জীবন কাটাচ্ছেন একজন হিন্দুর সঙ্গে। একই কাহিনী ইমানুলের ভাই জয়নুল হক ও তার স্ত্রী সীমা সাহারও।
ইমানুল বলেন, ‘বিয়ের জন্য আমাদের পরিবারের কোনো নারী ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হননি। বরং তারা নিজস্ব ধর্মাচরণ করেন। কিন্তু বিজেপি নেত্রী হেমামালিনী নিজেই ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন বিয়ের সময়। বিজেপির শীর্ষ নেতা শাহনওয়াজ হুসেন ও মুখতার আব্বাস নকভির স্ত্রী হিন্দু। এদের কী হবে?’
আরও অনেকে বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে তো এমন অনেক উদাহরণও আছে, যেখানে পাত্র হিন্দু আর পাত্রী মুসলিম। সে ক্ষেত্রে কি ধর্মান্তরণের কোনো অভিযোগ উঠবে না? যদি কেউ তোলেন তখন এর উত্তর কী হবে?
পশ্চিম মেদিনীপুরের টুম্পা খাতুন মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বাড়ি ছেড়ে চলে যান। বিয়ে করেন মোনা দা’কে। তিনি খাবারের দোকান চালান। টুম্পা বিয়ের জন্য ধর্মান্তরিত হন। পরিবারের একাংশের আপত্তি এখনো রয়েছে।
তবু তা অগ্রাহ্য করে এক সন্তান নিয়ে সুখী দাম্পত্য তাঁদের। টুম্পা খাতুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমি পূজা করি, ব্রত-উপবাসও করি। লাভ জিহাদ এর কথা তো জানি না, শুধু লাভ জানি। আমরা বেশ ভালোই আছি।’
বিয়ের আগেই হিন্দু ধর্মকে ভালোবেসে বেলুড় মঠে দীক্ষা নিয়েছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী ঝুমা মণ্ডল। এক বছর আগে বিয়ে করেন পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ কর্মকর্তা সোমনাথ সাহাকে। তিনিও একই সুরে কথা বলেন।
ঝুমা মণ্ডল আইনটির সমালোচনা করে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমরা দুজনই লাভ জিহাদ এর প্রচারকে ঘৃণা করি। প্রেমের সম্পর্ককে এভাবে কলুষিত করা ঠিক নয়। ভালোবাসা আর জিহাদ একসঙ্গে থাকতে পারে না।’
বীরভূমের দুবরাজপুরের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক শুভজিৎ রায় বিয়ে করেছেন নাজমা খাতুনকে। এখন তিনি নাজমা রায়। শুভজিৎ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমার গুরুর শিক্ষা, ধর্মীয় বিভেদ ঘোচানোর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ভিনধর্মে বিয়ে করা। আমি অনেক প্রতিকূলতার মুখেও তা করেছি। সুখের পরোয়া করিনি।’
তার প্রস্তাব, ‘অন্য ধর্মে বিয়ে একটা আন্দোলন হয়ে উঠতে পারে। সকলে এগিয়ে আসুন, ধর্মীয় পরিচয় ভুলে ভালোবাসুন। তাহলে লাভ জিহাদ এর মতো প্রচার হার মানবেই।’
এসএ/এইচএ/পিআর