দেশের ৭৩ শতাংশ মেয়েই বাল্য বিয়ের শিকার


প্রকাশিত: ১২:০৭ পিএম, ১০ নভেম্বর ২০১৫
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ৭৩ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় বলে এক সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে । সমীক্ষায় বলা হয়,  ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সেই ২৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে থাকে। পাশাপাশি ছেলেদের ক্ষেত্রে এর হার ২ দশমিক ৮০ শতাংশ।

এশিয়া চাইল্ড ম্যারেজ ইনিশিয়েটিভ বিষয়ক সমীক্ষাটি পরিচালনা করেছে আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল এবং যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোর্জাশম ইন্টারন্যাশনাল।

এশিয়ার তিনটি রাষ্ট্রে (বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া) এ সমীক্ষা চালানো হয়। সমীক্ষায় বেরিয়ে আসে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সের মেয়ে শিশুসহ অন্য সকলের বাল্যবিবাহ এলাকাবাসী, মেয়ের বাবা-মা এবং মেয়ে শিশু নিজে সমর্থন করছে।

প্রতিবেদনে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার অভাব এবং দারিদ্র, দুর্বল বিচার ব্যবস্থা ও অকার্যকর আইন প্রয়োগ প্রক্রিয়াকে বাল্য বিয়ের কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়।

মঙ্গলবার দিনব্যাপী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ‘প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল’আয়োজিত এক সেমিনারে এ সমীক্ষা প্রকাশ করা হয। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর সেনেত গ্যাব্রিজিবারের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি।

এসময় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম এনডিসি, বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনার বেনুত পিরে লারামি ও ইউএনএফপিএ বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ আর্জেন্টিনা পিনতো মেটাভাল পিছিন প্রমুখ।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয় - ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই বাংলাদেশে ৭৩ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। ইন্দোনেশিয়ায় এই হার মেয়েদের ক্ষেত্রে ৩৮ শতাংশ। দেশটিতে ছেলেদের ক্ষেত্রে এর হার ৩ দশমিক ৭০ শতাংশ।

অন্যদিকে, পাকিস্তানে ৩৪ দশমিক ৮০ শতাংশ মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়ে থাকে। যা প্রকাশিত জরিপে সর্বনিম্ন। এদেশে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে থাকে। আর ছেলেদের ক্ষেত্রে পাকিস্তানে এর হার সবোর্চ্চ ১৩ শতাংশ।  

গবেষণায় একটি জনগোষ্ঠীতে শিক্ষার হার (সন্তান ও বাবা-মা উভয়ের), উপার্জন, অর্থনৈতিক সুযোগ, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগ এবং সামাজিকভাবে বাল্যবিবাহের সমর্থন প্রদানের প্রবণতার মধ্যে সরাসরি সংযোগ খুজেঁ পাওয়া গেছে।

এতে বল হয়, উল্লেখিত সুযোগগুলো প্রাপ্তির হার বৃদ্ধি পেলে তা বাল্যবিবাহের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস করতে পারে। তিনটি দেশে পরিচালিত প্রতিবেদনের শেষে বাল্যবিবাহ রোধে ৪০টি জোরালো ও বাস্তবধর্মী পরামর্শের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল তিনটি দেশে আলাদাভাবে মোট ২ হাজার ৭৪২টি জরিপ সম্পন্ন করে। ১৫৮টি আংশিক লিখিত প্রশ্নের ভিত্তিতে কমিউনিটি সদস্য (১২ থেকে ১৪ বছর বয়সী ছেলে-মেয়ে, তরুণ-তরুণী ও বাবা-মা) এবং সংশ্লিষ্ট সকলের (স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিবাহ নিবন্ধনকারী, শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী ও বাল্যবিবাহের শিকার ছেলে-মেয়েদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। ১২ থেকে ২৫ বছর বয়সী তরুণ-তরুণী, শিশু এবং তাদের বাবা-মাদের সাথে মোট ৪৭টি ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন কার্যক্রম চালানো হয়েছে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, বর্তমান সরকার দেশে বাল্যবিবাহ কমিয়ে আনতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবে এ সমস্যাটি রাতারাতি সমাধান সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, প্রথমে এ সমস্যা সমাধনে আমাদের এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে, কারা এ সমস্যার জন্য দায়ি তা চিহ্নিত করতে হবে এবং আমাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে যাতে এ সমস্যা কোন জায়গায় গিয়ে সমাধান করা যায়। এতে সবাই মিলে কাজ করলে লক্ষ্যটার সফলতার মুখ দেখবে বলে তিনি মনে করেন।

চুমকি বলেন, ইতোমধ্যে সরকার বলেছে ২০২১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ বন্ধ করবে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে সর্ম্পূণরূপে বন্ধ হবে। বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ, সরকার ঘোষণা দিয়েছে আগামী ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার। এতে অবশ্যই আমাদের বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে, তবে শতভাগ করতে পারব না। তবে এরই আলোকে আমরা এগিয়ে যেতে চাই।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় বাল্যবিবাহ রোধে জোর দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিভাবে দেশে বাল্যবিবাহ রোধ করা যায় তার উপর জোর দিচ্ছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

এ লক্ষ্যে ২০১৬ সালে এই মন্ত্রণালয় সবচেয়ে  গুরুত্বপূর্ণ দুটি কাজ হবে পথ শিশুরা যাতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে না বেড়ায় এবং বাল্যবিবাহের হার কমানো। এ লক্ষ্যে আমরা কর্ম-পরিকল্পনা শুরু করেছি। বাল্যবিবাহ রোধের লক্ষ্যে ২০১৬ সালে দেশের প্রতিটি জেলায় কর্মসূচি দেয়া হবে বলেও এসময় তিনি জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক শিক্ষাকে সকল সামাজিক রোগ নিরাময়ের মহা-ওষুধ আখ্যায়িত করে বলেন, ব্যবহারিক শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে পারলে বাল্য-বিয়েসহ সমাজের সকল ব্যাধি দূর করা সম্ভব হবে।  

উপাচার্য বলেন, বাল্য বিয়ের মাধ্যমে মেয়েদের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। তিনি বাল্যবিয়ে রোধে তৃণমূল পর্যায়ে নারী শিক্ষা প্রসারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

ড. মিজানুর রহমান বলেন, রাষ্ট্র প্রত্যেকটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এ বাল্যবিবাহ অনেকাংশে কমে আসতে বাধ্য। কেননা রাষ্ট্র আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না, আমার মেয়ে রাস্তায় চলতে পারবে না, আমার মেয়ে কলেজে-স্কুলে-মার্কেটে যেতে পারবে না আর আমরা মামলা করেও কোনো বিচার পাবো না তাহলে এ প্রথা বন্ধ হবে না।

তিনি বলেন, বাবা-মা অবুঝ নন। কেউ কেউ বলেন বাবা-মা বুঝেন না। আসলে তা নয়। বাবা-মা সব বুঝেন কিন্তু তারা যদি তাদের সন্তানটির নিরাপত্তা ঝুঁকিতে মনে করেন তাহলে তারা তো বাল্যবিবাহ দিতে বাধ্য হবে। আর সে জায়গায় আমাদের রাষ্ট্র ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। তাই রাষ্ট্রকে আমরা ব্যর্থ দেখতে চাই না। তাই রাষ্ট্রকে এসব বন্ধে এগিয়ে আসতে হবে।

এমএইচ/এসকেডি/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।