জো বাইডেনের জয়ে নতুন বাস্তবতায় উপসাগরীয় নেতারা
‘আমার মনযোগে যদি একটু-আধটু ঘাটতি দেখেন, ক্ষমা করে দিয়েন’- যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর গত সপ্তাহে বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনারকে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় হঠাৎ এমন মন্তব্য করেন লন্ডনে নিযুক্ত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত প্রিন্স খালিদ বিন বানদার।
বারবার তার মোবাইল ফোনের দিকে তাকাচ্ছিলেন সৌদি রাজপরিবারের প্রভাবশালী এই রাজপুত্র। তিনি বলেন, উইসকনসিনের ফলাফলের দিকে চোখ রাখছি।
আট দিন আগের কথা এটি, যখন কেউই জানতেন না জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসের ক্ষমতায় কে বসছেন। তারপর জো বাইডেনকে যখন বিজয়ী ঘোষণা করা হলো, রিয়াদে সৌদি নেতৃত্ব সাড়া দিতে বেশ সময় নিয়েছেন। অথচ চার বছর আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন জিতেছিলেন অভিবাদন জানাতে মুহূর্ত দেরি করেননি তারা।
তবে বিবিসির ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনার মনে করেন- এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ সৌদি নেতৃত্ব গত সপ্তাহে বিশ্বের অত্যন্ত ক্ষমতাধর একজন বন্ধুকে হারিয়েছে। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় সৌদি আরব এবং উপসাগরে তাদের অনুগত মিত্র দেশগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদী কিছু পরিণতি অপেক্ষা করছে।
কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলের সঙ্গে আমেরিকার সহযোগিতার সম্পর্ক ১৯৪৫ সাল থেকে। ওঠানামা থাকলেও এ সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে, কিন্তু তাতে পরিবর্তন আসন্ন এবং সেই পরিবর্তনের অনেক কিছুই উপসাগরীয় নেতাদের পছন্দ হবে না।
বড় এক বন্ধুর প্রস্থান
সৌদি রাজপরিবারের বড় একজন মিত্র এবং সমর্থক ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৭ সালে ক্ষমতা নেয়ার পর তার প্রথম আনুষ্ঠানিক বিদেশ সফর শুরু করেছিলেন তিনি সৌদি আরব দিয়ে। ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার ক্ষমতাধর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।
২০১৮ সালে স্বেচ্ছা নির্বাসিত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ডে যখন সিআইএসহ পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যুবরাজ মোহাম্মদকে সন্দেহ করে, তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ নিয়ে কথা বলতে অস্বীকার করেন।
প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড সম্প্রতি প্রকাশিত তার সাড়া জাগানো একটি বইতে লিখেছেন- তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গলা উঁচিয়ে বলেছিলেন তিনি সৌদি যুবরাজকে রক্ষা করেছেন।
জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পর মার্কিন কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে ৮০০ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি অনুমোদন করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ বন্ধে কংগ্রেসে এক প্রস্তাবে তিনি ভেটো দেন।
ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনার বলছেন, বোঝাই যায় যে কেন তারপর যুবরাজ মোহাম্মদের লোকজন বলেছিলেন- আর কোনও (খাসোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে) চিন্তা নেই। আমরা ব্যবস্থা করে ফেলেছি।
সুতরাং বলাই বাহুল্য, সৌদি আরব এবং সেই সঙ্গে কিছুটা হলেও সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন হোয়াইট হাউসে তাদের বড় একজন মিত্র হারাতে বসেছে। তবে তাতে যে সবকিছুই বদলে যাবে তা হয়তো নয়, তবে কোথাও কোথাও বর্তমান পরিস্থিতি বদলে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
ইয়েমেন যুদ্ধ
ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের যুদ্ধে এবং এর ফলে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় নিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা শেষ দিকে ক্রমেই অস্বস্তি প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও একই মত পোষণ করতেন।
প্রেসিডেন্ট ওবামা যখন হোয়াইট হাউস ছাড়েন, তখন ইয়েমেনের যুদ্ধের দু'বছর পার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সামরিক কোনও সুফল তো আসেনি, বরং ইয়েমেনে জানমাল এবং অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল। মার্কিন কংগ্রেসের ভেতর ইয়েমেনের যুদ্ধ নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হতে শুরু করে; যার ফলে প্রেসিডেন্ট ওবামা সৌদি আরবে সামরিক এবং গোয়েন্দা সহযোগিতা কমিয়ে দেন। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই সেসব সাহায্য ফিরিয়ে আনেন।
সেই চিত্র আবারও বদলে যেতে পারে। সম্প্রতি গবেষণা সংস্থা কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশন্সে এক বক্তৃতায় জো বাইডেন স্পষ্ট করে বলেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বে সর্বনাশা যুদ্ধে আমেরিকার সাহায্য বন্ধ করে দেবেন। শুধু তাই নয়, জো বাইডেন বলেন, সৌদি আরবের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক নতুন করে পর্যালোচনার নির্দেশ দেবেন তিনি।
সুতরাং ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধে সৌদি আরব এবং ইয়েমেনে তাদের মিত্রদের ওপর বাইডেন প্রশাসনের যে চাপ বাড়বে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনার বলছেন, সৌদি এবং আমিরাতিরাও সম্প্রতি উপলব্ধি করতে শুরু করেছে যে যুদ্ধ করে ইয়েমেনে জয় সম্ভব নয়।
গার্ডনার বলেন, তারা মুখ রক্ষা করে সংঘাত থেকে বেরুনোর একটা রাস্তা খুঁজছে। তারা শুধু দেখাতে চায়, ২০১৫ সালে যুদ্ধ শুরুর সময় হুতি বিদ্রোহীদের যে শক্তি ছিল, এখন তা আর তাদের নেই।
ওয়াশিংটন থেকে বিবিসির বারবারা প্লেট বলছেন, ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বে যুদ্ধের প্রতি আমেরিকার সমর্থন প্রায় নিশ্চিতভাবে প্রত্যাহার করবেন জো বাইডেন। বেসামরিক লোকজনের মৃত্যু, মানবিক বিপর্যয়ের কারণে ইয়েমেনের যুদ্ধের বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মধ্যে বড় ধরনের অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।
ওয়াশিংটনে গবেষণা সংস্থা আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের মেরি ড্যানিয়েল প্লেটকা বিবিসিকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে বিশাল কোনো পরিবর্তন হয়তো দেখা যাবে না, কিন্তু সৌদি আরবের কাছ থেকে একটু দূরে সরে যাওয়া এবং ইরানের সঙ্গে আলাপ বাড়ানোর সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত।
ইরান
প্রেসিডেন্ট ওবামার মধ্যপ্রাচ্য নীতির সবচেয়ে বড় ছাপ ছিল ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি যেটি জয়েন্ট কমপ্রিহেন্সিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেপিসিওএ) নামে পরিচিত। এই চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল ইরানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করে সেদেশকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখা।
তবে সৌদি আরব এবং ইসরায়েলের এই চুক্তি নিয়ে তীব্র আপত্তি ছিল। তাদের যুক্তি ছিল- এই বোঝাপড়ার মাধ্যমে ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা থেকে বিরত রাখা যাবে না, বরং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে তাদের শক্তি বাড়বে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও এই যুক্তি পুরোপুরি গ্রহণ করেন। তার ভাষায়, সর্বকালের সবচেয়ে জঘন্য চুক্তি থেকে একতরফা সিদ্ধান্তে তিনি আমেরিকাকে বের করে আনেন।
এখন তার উত্তরসূরি জো বাইডেন ওই চুক্তিতে আবারও অংশীদার হওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছেন। আর এই সম্ভাবনায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন সৌদি আরব।
গত বছর সৌদি তেল স্থাপনায় রহস্যজনক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর রিয়াদে সৌদি সরকারের এক সংবাদ সম্মেলনে সেদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আদেল আল জুবায়ের ইরানের পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
সৌদি আরবের এই মন্ত্রী বলেছিলেন, ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি সর্বনাশ ডেকে আনছে। কারণ তার মতে, এই চুক্তিতে ইরানের ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি এবং সেই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তাদের অনুগত মিলিশিয়াদের যেভাবে ইরান শক্তিশালী করে চলেছে তাও ভাবা হয়নি।
আদেল আল জুবায়ের বলেন, ইরানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক এই চুক্তি ওবামা প্রশাসনের একটি ভ্রান্ত নীতি ছিল। কারণ ওই সরকার বুঝতে পারেনি যে ইসলামি প্রজাতন্ত্রটি মধ্যপ্রাচ্যে কতটা হুমকি তৈরি করেছে।
জানুয়ারি মাসে যখন ইরাকে আমেরিকান ড্রোন হামলায় ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের অত্যন্ত ক্ষমতাধর কমান্ডার কাসেম সোলায়মানিকে হত্যা করা হয়, তখন সৌদি আরব এবং তার উপসাগরীয় মিত্ররা খুশি হয়েছে।
ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনার মনে করেন, এখন এই দেশগুলো সত্যিই উদ্বিগ্ন যে তাদের স্বার্থের কথা বিবেচনা না করে নতুন মার্কিন প্রশাসন আবারও ইরানের সঙ্গে মীমাংসা শুরু করবে।
কাতার
মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবচেয়ে বড় এবং কৌশলগত দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বিমান ঘাঁটি কাতারে। আল উদাইদ বিমান ঘাঁটি থেকে পেন্টাগন সিরিয়া, আফগানিস্তানসহ এই পুরো অঞ্চলের বিমান অভিযান পরিচালনা করে।
কিন্তু তারপরও, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর এবং বাহরাইন কাতারের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রেখেছে। এই দেশগুলোর প্রধান অভিযোগ যে কাতার মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম ব্রাদারহুডের মত ইসলামপন্থীদের সমর্থন দিচ্ছে।
২০১৭ সালে রিয়াদে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সফরের পরপরই কাতারকে বয়কটের সিদ্ধান্ত জানায় এই চার দেশ। তারা পরিষ্কার জানে যে তাদের এই সিদ্ধান্তে আমেরিকার প্রশাসনের সমর্থন থাকবে।
ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনার বলেন, প্রথমদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই বয়কট সমর্থন করলেও পরে তাকে বোঝানো হয়, কাতারও আমেরিকার মিত্র এবং কাতারের আল উদাইদ বিমান ঘাঁটিটি আমেরিকার প্রতিরক্ষা দপ্তরের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জো বাইডেন এখন উপসাগরীয় অঞ্চলের এই বিবাদ মিটিয়ে ফেলার জন্য হয়তো চাপ দেবেন। কারণ এই কলহ আমেরিকার জন্য অস্বস্তিকর এবং তাদের স্বার্থ বিরোধী।
মানবাধিকার
উপসাগরীয় দেশগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সবসময় কম-বেশি উদ্বেগ রয়েছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কখনই এ নিয়ে মাথা ঘামাননি।
তার কথা ছিল- সৌদি আরবে কারাবন্দী নারী অধিকার কর্মীদের ইস্যু বা কাতারে বিদেশি শ্রমিকদের কথিত নির্যাতন বা ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের মধ্যে সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ড নিয়ে হইচই করার চেয়ে উপসাগরে আমেরিকার কৌশলগত স্বার্থ এবং ব্যবসা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত জো বাইডেন এবং তার প্রশাসন মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব বিষয় নিয়ে একইভাবে যে চুপ থাকবেন না তা একরকম নিশ্চিত।
তবে সৌদি আরব বা ইরান নিয়ে বাইডেন প্রশাসন কী করবে তা অনেকটাই স্পষ্ট হবে; যখন তিনি তার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগ দেয়া শুরু করবেন। কে তার পররাষ্ট্র মন্ত্রী, পেন্টাগনের দায়িত্ব পাবেন, জাতীয় নিরাপত্তা প্রধান উপদেষ্টা হবেন; তা থেকে বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি নিয়ে অনেকটাই স্পষ্টভাবে ধারনা করা সম্ভব হবে। বিবিসি বাংলা।
এসআইএস/এমকেএইচ