ভাসানচরকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করবে সবুজ বেষ্টনী
পরিকল্পিত সবুজায়নের ফলে দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছে মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা ভাসানচর। সেখানে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের সাময়িকভাবে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হলেও এর বনায়নের লক্ষ্য সুদূরপ্রসারী। এ জন্য সেখানে উপকূলীয় গাছ ছাড়াও দেশীয় নানা ফলের গাছ লাগানো হয়েছে এবং হচ্ছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য দ্বীপের চারদিকে বনায়নের মাধ্যমে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী তৈরি করা হচ্ছে।
সম্প্রতি ভাসানচর গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে প্রশস্ত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে, যা ঘূর্ণিঝড়কালীন সমুদ্রের ঢেউয়ের প্রকোপ থেকে দ্বীপের ভূমি রক্ষা করবে। এ প্রকল্পটি সরকার প্রণীত ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। সেখানে প্রয়োজন ছাড়া কোনো গাছ কাটা হয়নি। ফলে এখনও বিস্তৃত বনাঞ্চল রয়েছে।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক কমোডর আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী জাগো নিউজকে জানান, ভাসানচর মোট ১৩ হাজার একরের হলেও মাত্র এক হাজার ৭০০ একর জমির চারদিকে বাঁধ দিয়ে ৪৩২ একরের ওপর আবাসন ও অন্যান্য স্থাপনা করা হয়েছে। ৩৫২ একর জমি নৌবাহিনীর ফরওয়ার্ড বেইজের জন্য নির্ধারিত রয়েছে। ৯৩২ একর ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণের জন্য ফাঁকা রাখা হয়েছে। ফলে এখন এক লাখ রোহিঙ্গাকে এখানে স্থানান্তরের পর চাইলে পুরো ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে ধীরে ধীরে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা সম্ভব। এসব করা হয়েছে ভাসানচরের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষা করে। ঘূর্ণিঝড়ের জন্য তৈরি শেল্টারে ২৬০ কিলোমিটার গতির ঝড়েও অটুট থাকবে।
সেখানে বৃক্ষরোপণের জন্য একটি নার্সারিও গড়ে তোলা হয়েছে। নার্সারিতে আমলকী, পেয়ারা, মেহগনি, কলা, লেবু, আমড়া, রেইনট্রি, চিকরাশি, বেল, আম, জাম্বুরা, মালটা ও বহেরা গাছ রয়েছে। এছাড়া ড্রাগন ফলের বাগান। সেখানে ড্রাগনও ধরেছে। লাগানো হয়েছে প্রচুর নারিকেল গাছ। রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মিত প্রতিটি আবাসিক ভবনের সামনে লেবুর গাছ লাগানো হয়েছে। রয়েছে তুলসী গাছও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেখানকার নার্সারিতে কর্মরত পিরোজপুরের আবদুল কাদের শেখ জাগো নিউজকে বলেন, এ পর্যন্ত ৭০ হাজার গাছ লাগিয়েছি। বেড়িবাঁধ রক্ষার জন্য গোলপাতা, কেওড়া লাগিয়েছি। বাঁধের ভেতর কমলা, মাল্টা, পেয়ারা, ড্রাগন লাগানো হয়েছে। প্রথম প্রথম এখানে গাছ হতো না। কিন্তু বাঁধ দেয়ার পর আর লবণাক্ত পানি ঢুকতে পারে না। ধীরে ধীরে মাটিতে থাকা লবণ বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে। এ জন্য তিন বছর ধরে ধান চাষও ভালো হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য চলমান প্রকল্প শুধু সেপটিক ট্যাংক ও সোকঅয়েল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। দ্বীপটির ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় এবং মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে পরিবেশবান্ধব করার লক্ষ্যে সেপটিক ট্যাংক ও সোকঅয়েলকে সমন্বয় করে যুগোপযোগী বায়োগ্যাস প্লান্ট অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব বায়োগ্যাস প্লান্টে সীমিত পরিসরে রান্নার জন্য জ্বালানি গ্যাস এবং বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে কমপোস্ট সার পাওয়া যাবে। এছাড়া পরিবেশবান্ধব গ্রিন ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট ও কমপোস্ট প্রসেসিং ইউনিট নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেখানে আছে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার মান মেনে ভূগর্ভস্থ পানি এবং পুকুর, হ্রদ ও খালের ব্যবস্থা।
প্রাথমিকভাবে সেখানে ৩০৬ জন রোহিঙ্গাকে রাখা হয়েছে। এরা প্রত্যেকে অবৈধপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছিলেন। সাগরে ভাসতে ভাসতে তাদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়েছিল। কিন্তু কোথাও ভিড়তে পারছিলেন না। পরে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ সরকার তাদের আশ্রয় দেয়। এদের মধ্যে ৯৭ জন পুরুষ, নারী ১৭৬ জন এবং শিশু ৩৩। তাদের অনেক নারী ইতোমধ্যে সেলাই কাজে অংশ নিচ্ছেন।
উল্লেখ্য, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মিত ভাসানচরের অস্থায়ী আবাসস্থল পুরোপুরি প্রস্তুত। মৌলিক সুবিধা নিয়ে এখানে প্রায় লাখ খানেক রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা হবে। প্রকৃতির অকৃত্রিম দান জল ও সবুজ গাছগাছালি বেষ্টিত নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার আওতাধীন দ্বীপটি এখন পরিকল্পিত বাসস্থানের বাস্তব উদাহরণ, যা দৃষ্টিনন্দনও বটে। এখানে কাজের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের বিনোদনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। যাতে সেখানে তারা হতাশ না হয়।
প্রকল্পটিতে যাতে এক লাখ এক হাজার ৩৬০ জন শরণার্থী বসবাস করতে পারেন সেই ব্যবস্থার আলোকে গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি গৃহে, প্রতি পরিবারের চারজন করে মোট ১৬টি পরিবার বসবাস করতে পারবে। এছাড়া প্রতিটি ক্লাস্টারের জন্য দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে আশ্রয় নেয়ার জন্য তৈরি শেল্টার স্টেশনে স্বাভাবিক সময়ে ২৩টি পরিবার বসবাস করতে পারবে।
এ হিসাবে ক্লাস্টারের ১২টি হাউজে মোট ৭৬৮ জন এবং একটি শেল্টার স্টেশনে মোট ৯২ জনসহ মোট ৮৬০ জন সদস্য বসবাস করতে পারবেন। প্রতিটি হাউজের একপ্রান্তে বসবাসকারী পরিবারের নারী-পুরুষের জন্য আলাদা গোসলখানা, শৌচাগার ও রান্নাঘরও রয়েছে।
কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তরিত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা চাইলে অর্থনৈতিক নানা কাজে অংশ নিতে পারবেন। সেখানে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অসহায় রোহিঙ্গারা যাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারেন এবং তারা যাতে দক্ষ কর্মী হয়ে মিয়ানমার ফিরে যেতে পারেন সে জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার।
ভাসানচরে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে বসবাসকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধ্যতামূলক নয়। তারা অন্য শরণার্থীদের মতো কার্ডের মাধ্যমে রেশন ও খাবার পাবেন। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক এবং রোহিঙ্গারা চাইলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আশ্রয়ণ-৩ এর প্রকল্প পরিচালক কমোডর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, আমরা প্রকল্পে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রেখেছি। মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। রোহিঙ্গাদেরও মতামত নেয়ার বিষয় আছে।
এইচএস/বিএ/এমকেএইচ