প্রেরণার নাম বাংলাদেশ


প্রকাশিত: ০২:৩৯ এএম, ০৬ নভেম্বর ২০১৫

‘বাংলাদেশ থেকে আমরা প্রেরণা নিতে পারি। জিম্বাবুয়ে এখন যে জায়গাটিতে কয়েক বছর আগে একই অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। আমরা এই সিরিজে ভাল খেলতে চাই। পরীক্ষায় ফেলতে চাই স্বাগতিকদের’- কথাগুলো সাবেক বাংলাদেশ ও বর্তমানে জিম্বাবুয়ে কোচ ডেভ হোয়াটমোরের। মঙ্গলবার সফরকারী দলের অনুশীলনের প্রথম দিনেই  ‘বর্তমান বাংলাদেশ’ হয়ে ওঠার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটে এক সময়ে অনেক সুখ- দুঃখের সঙ্গী হোয়াটমোর। নব্বই পরবর্তী  দুদশকে বাংলাদেশের স্বপ্ন ছিল ‘জিম্বাবুয়ে হয়ে ওঠা’। সময়ের পরিক্রমায় আজ বাংলাদেশকে মানদণ্ড বিবেচনা করছে হিথ স্ট্রিক-অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার-গ্রান্ট ফ্লাওয়ারদের দেশ। শুধু জিম্বাবুয়েই নয়, বিশ্ব ক্রিকেটে ভিন্ন এক মানদণ্ড  দাঁড় করিয়েছে বাংলাদেশ। আয়োজনের সক্ষমতা, বাস্তবতার সঙ্গে তাল রেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া, মাঠ ও মাঠের বাইরে চ্যালেঞ্জ নেয়া এই বাংলাদেশকে অনুসরণীয় হিসাবে মনে করছে ক্রিকেট বিশ্বের অনেক দেশই।

বিপিএল তৃতীয় আসরের আয়োজন প্রায় চূড়ান্ত। বিপিএলকে ঘিরে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের চেয়ে কোন অংশে উচ্ছ্বাস কম নাই অন্য দেশের ক্রিকেটারদেরও। আগের দুটো আসরে দেখা গেছে, অংশ নেয়া পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের ভাষ্য- ‘বিপিএল হচ্ছে আমাদের আইপিএল।’ রাজনৈতিক কারণে আইপিএলে অংশ নেয়ার সুযোগ নাই পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের। বিপিএলের মধ্য দিয়েই আইপিএলের দুঃখ ভোলে পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা। ছয় মাস আগে বাংলাদেশ সফর করে গেছে পাকিস্তান। ওই সফরে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে টাইগারদের কাছে হোয়াইটওয়াশের লজ্জায় ডোবে দলটি। এ নিয়ে পাকিস্তান ক্রিকেটকে অনেক কাটা-ছেঁড়া হয় তাদের মিডিয়ায়। তবে পাকিস্তানি সাবেক ক্রিকেটাররা বাংলাদেশের উন্নতিকে দেখেছে ইতিবাচক চোখেই। বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন করে পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে যাচ্ছে এখান থেকে পাকিস্তানের শেখার অনেক কিছু আছে। তাদের সাবেক অধিনায়ক  রশিদ লতিফ  থেকে শুরু করে এমন কথা বলেছেন সেদেশের অনেক গ্রেটই। 

বাংলাদেশে ক্রিকেটে অবকাঠামো উন্নয়ন কতটুকু হয়েছে সেটা নিয়ে অনুসিদ্ধান্ত টানার সময় এখনও আসেনি। তবে  পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা যে বিসিবির আছে এটা অনুধাবন করার জন্য প্রয়োজন পড়ে না বিশেষজ্ঞ হওয়ার।  ধরা যাক, এ বছরের গোড়ার দিকে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের কথাই। অস্ট্রেলিয়া- নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধ কন্ডিশনে টাইগাররা কতটুকু কি করতে পারবে এনিয়ে ঘোর সংশয়ে ছিল দেশের অনেক ক্রিকেট ভক্তই। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধ কন্ডিশনকে মাথায় রেখে মাশরাফি মর্তুজাদের কোচ হিসাবে বিসিবি নিয়োগ দেয় চন্ডিকা হাথুরুসিংহকে। অস্ট্রেলিয়ায় কোচিংয়ের  অভিজ্ঞতা যে গুরুত্বপূর্ণ সেই ভাবনা থেকেই আনা হয় লংকান কোচ হাথুরুকে। বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রেলিয়া-নিউজল্যান্ডে সিরিজ খেলার  সুযোগ মেলেনি বাংলাদেশে। বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রেলিয়ায় আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে ভারত, নিউজিল্যান্ডে খেলেছে শ্রীলঙ্কা। বড়দের এই রেসে সুযোগ করে নিতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে থেমে থাকেনি বিসিবি। হেঁটেছে বিকল্প পথে। বিশ্বকাপ শুরুর তিন সপ্তাহ আগে অস্ট্রেলিয়ায় অনুশীলন ক্যাম্প করেছে বাংলাদেশ। স্থানীয় দলগুলোর সঙ্গে খেলেছে কয়েকটি প্রস্তুতি ম্যাচও। যার ফল হিসাবে কন্ডিশন জয়ের চ্যালেঞ্জে খুব ভালোভাবে উতরে গেছে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের নক আউট পর্বে উন্নীত হওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছে টাইগাররা। আর এটা করার পথে ক্রিকেটের কুলীন দল ইংল্যান্ডকে হারিয়েছে মাশরাফিরা।

ঘরের মাটিতে সর্বশেষ সিরিজগুলোতে বাংলাদেশ ওয়ানডে সিরিজে একে একে হারিয়েছে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে। এর মধ্য দিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসল বাংলাদেশ। তবে কেউ কেউ এই উত্থানকে খুব একটা আমলে নিলেন না। বিদেশের মাটিতে না জেতা পর্যন্ত বাংলাদেশের উন্নতিকে প্রকৃত উন্নতি বলতে নারাজ অনেকেই। এই দলের সবচেয়ে সোচ্চার কণ্ঠ ইংল্যান্ডের কিংবদন্তীর ওপেনার ও জনপ্রিয় টিভি ধারাভাষ্যকার জিওফে বয়কট। তার সঙ্গে সুর মেলালেন অনেকেই। এ পর্যায়ে ভারতের কিংবদন্তী অধিনায়ক সুনীল গাভাস্কার বললেন,‘ক্রিকেটে বিদেশ জয় মোটেও সাধারণ ব্যাপার নয়। ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্টইন্ডিজ আর স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়া ছাড়া  ক্রিকেটের আর কোন দলই সেভাবে বিদেশে সফলতা পায়নি। আমি মনে করি, বাংলাদেশ ক্রিকেট সঠিক পথেই এগুচ্ছে।’ বাংলাদেশের উন্নতির পক্ষে- বিপক্ষে সাবেক গ্রেটদের এই  আলোচনা-সমালোচনাই বলে দেয় অনেক কিছু। আর এ কারণেই বোধকরি নিরাপত্তার অজুহাতে বাংলাদেশ সফর বাতিল করাতে খোদ নিজের দেশে সমালোচিত অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল। হেরে যাওয়ার আশঙ্কায় বাংলাদেশ সফর করেনি অস্ট্রেলিয়া- এমন অভিমত সাবেক অসি গ্রেট ডিন জোন্সের। একই সুরে কথা বলেছেন, কিংবদন্তীর রেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন। সব কথার এক কথা, ছোট-বড়র ব্যবধান ঘুচিয়ে ছোটদের আদর্শ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ।

‘আমরা বাংলাদেশের মত টেস্ট খেলতে চাই’- মোহাম্মদ নবী থেকে শুরু করে আফগানিস্তানের প্রায় সব ক্রিকেটারই এমন কথা বলেন প্রায়শই। সম্প্রতি জিম্বাবুয়ের মাটিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে ও টি২০ সিরিজ জিতেছে আফগানরা। বাংলাদেশ হয়ে ওঠার স্বপ্ন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির ক্রিকেটকে। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের একটা ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। ওই বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে ভারতকে হারিয়ে সুপার এইটে (সেরা আট) জায়গা করে নেয় টাইগাররা। গ্রুপ পর্বে বাকি দুটো দল ছিল শ্রীলঙ্কা ও বারমুডা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক অচেনা নাম বারমুডা। বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচের আগে বারমুডা অধিনায়ক বললেন- ‘বাংলাদেশের মত আমরাও নিয়মিতভাবে  আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে চাই। এক সময় আমরা বাংলাদেশকে হারিয়েছি।’ বলা বাহুল্য, ১৯৮৬ এর আইসিসি চ্যাম্পিয়নশীপে প্রথমবারের মত সেমিফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ। ওই আসরে গ্রুপ পর্বে বারমুডার কাছে ৭ উইকেটের ব্যবধানে হেরেছিল বাংলাদেশ। ওই আসরে সেমিফাইনালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৮ উইকেটের ব্যবধানে হেরেছিল বাংলাদেশ।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের  বন্ধুর পথে ধাপে ধাপে ছোট থেকে আজ ক্রিকেটে বড় হয়ে ওঠার সম্ভাবনার  জায়গাটিতে বাংলাদেশ। এসব ছোট বিষয় হয়ত ইংলিশ গ্রেট বয়কটদের বড় চোখে ধরা পড়ে না। আয়োজনের সামর্থ্যে বিশ্বের যে কোন দেশের সঙ্গেই সমানতালে পাল্লা দিতে পারে বাংলাদেশ এই প্রমাণিত সত্যকে গ্রাহ্যের মধ্যে না নিয়েই বাংলাদেশ সফর বাতিল করতে পারে ক্রিকেটের কুলীন দল অস্ট্রেলিয়া। এই সত্যগুলোর পাশাপাশি আরও কিছু সত্য আছে। লিলিপুটদের গালিভার হয়ে ওঠার স্বপ্নের সবটুকু জুড়েই যে বাংলাদেশ। এ সত্যকে মুছে ফেলার সাধ্য কার? বাংলাদেশে  এসে এই সত্যটিকেই নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিলেন ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম আলোচিত কোচ ডেভ হোয়াটমোর।  

nazmul-topon

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।