নাগোরনো-কারাবাখ : যুদ্ধ কি এড়াতে পারবে বিশ্ব?
নাগোরনো-কারাবাখের আশপাশের শহরগুলোতে প্রতিনিয়ত গোলা পড়ছে। গত ১০ দিনে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে; যাদের বেশিরভাগই সৈন্য। স্থলে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার আগে আকাশে চক্কর দিচ্ছে তুরস্কের তৈরি ড্রোন, ধারণ করছে ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্য। দূরের কোনও স্থানে এটি শুধুমাত্র ছোট এক যুদ্ধ নয়। ইতোমধ্যে এতে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো জড়িয়েছে। এটি যেকোনও মুহূর্তে অত্যন্ত রক্তক্ষয়ী এবং নৃশংস রূপ পেতে পারে।
নাগোরনো-কারাবাখ একটি বিবাদপূর্ণ ছিটমহল। যেখানে আর্মেনীয় খিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর বসবাস। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মুসলিম অধ্যুষিত আজারবাইজান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় নাগোরনো-কারাবাখ। আর এতে সমর্থন জানিয়ে আজারবাইজানের বৃহৎ ভূখণ্ড দখলে নিয়ে ছিটমহলটির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে আর্মেনিয়া।
১৯৯০ দশকে দেশ দুটির মাঝে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে এবং বাস্ত্যুচুত হন ১০ লাখের বেশি। ১৯৯৪ সালে দুই দেশ অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে পৌঁছালেও সময়ে সময়ে সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বর্তমানে এই অঞ্চলে যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে তা একেবারেই ভয়াবহ।
আজারিরা বল প্রয়োগ করে হলেও হারানো ভূখণ্ড ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় মরিয়া। আর্মেনিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার একটি সামগ্রিক প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে। আজারবাইজানের প্রতি সমর্থন রয়েছে তুরস্কের। কারণ আজারিরা জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে তুরস্ক ঘেঁষা।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এই সংঘাতকে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী এবং মুসলিম বিশ্বের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে পেয়েছেন; যা তিনি ইতোমধ্যে সিরিয়া এবং লিবিয়ায় করছেন। রাশিয়া এখনও নীরবতার নীতিতে রয়েছে। তবে এই নীতি হয়তো খুব বেশিদিন টিকবে না।
আর্মেনিয়া-আজারবাইজান; উভয় দেশের সঙ্গে ইরানের সীমান্ত রয়েছে। শুধু তাই নয়, ইরানের বৃহৎ সংখ্যক আজারি সংখ্যালঘুর বসবাস রয়েছে। ইরান খুব সহজেই তাদের ফেরত পাঠাতে পারে। কাস্পিয়ান সাগর থেকে গ্যাস পাইপলাইনগুলোও রয়েছে ইরানের সম্মুখে।
নাগোরনো-কারাবাখ ঘিরে বহুমুখী এই সঙ্কটের সমাধান কি? ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বহির্বিশ্বের অনেকেই নাগোরনো-কারাবাখ সংঘাতের সমাধানে একটি রূপরেখা প্রণয়নের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এই অঞ্চলকে অবশ্যই আইনিভাবে স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বহুপক্ষীয় মতবাদের ভিত্তিতে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
‘এর বিনিময়ে ১৯৯০ দশকের শুরুর দিকে আজারবাইজানের যেসব জেলা আর্মেনিয়া দখলে নিয়েছিল সেগুলো ফেরত দিতে হবে এবং নাগোরনো-কারাবাখের সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখার জন্য আর্মেনিয়া শুধুমাত্র একটি করিডোর ধরে রাখতে পারে। উভয় দেশের সরকারই এক সময় এই নীতি ব্যাপকভাবে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে কেউই আপোষ করতে ইচ্ছুক নয়।’
প্রত্যেকের জন্য দুঃখজনক ঘটনা হলো- এ ধরনের সঙ্কট সমাধানের ব্যবস্থাগুলো ভেঙে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। এর অন্যতম একটি প্রতিবন্ধকতা হলো করোনাভাইরাস মহামারি। অতীতে স্থানীয় এবং আঞ্চলিক আস্থা গড়ে তোলার জন্য শান্তিকামী বিভিন্ন সংগঠন এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলো চেষ্টা করতো। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি বিশ্বজুড়েই সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে সেই কূটনীতিকে কঠিন করে তুলেছে।
যদিও বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা বৈশ্বিক নেতৃত্বের অনুপস্থিতি। ১৯৯৪ সালে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছাতে সহায়তা করেছিল আমেরিকা এবং রাশিয়া; বিশ্বের ক্ষমতাধর এ দুই দেশ নাগোরনো-কারাবাখ সংঘাতে যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে একই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে অন্তর্মূখী হয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। ক্ষমতায় আসার পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েল এবং আরব শাসকদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়েছেন; যা দেশের ভেতরেও ভালোভাবেই নিয়েছে জনগণ। কিন্তু শান্তি বজায় রাখার দীর্ঘদিনের চর্চিত যে কৃতজ্ঞতাহীন সূচি রক্ষণাবেক্ষণ করে চলতো যুক্তরাষ্ট্র; সেসব থেকে পুরোপুরি সরে আসে দেশটি।
পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর মিত্র তুরস্ক; যা অতীতে এরদোয়ানকে হস্তক্ষেপ বন্ধ করার আহ্বান জানাতে এবং যোদ্ধাদের অস্ত্র জমা দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগে একটি কার্যকর ফোরাম হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ন্যাটোর জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় খুব কম এবং আমেরিকা ছাড়া এই সংগঠনও একেবারে চালকবিহীন।
ককেশাস অঞ্চলে যুদ্ধ ঠেকাতে অতীতে মার্কিন প্রেসিডেন্টরা সময়, মস্তিষ্কের ক্ষমতা এমনকি প্রয়োজনে পেশীশক্তিরও ব্যবহার করেছেন। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এসব বিষয়ে কোনও আগ্রহই দেখা যায়নি।
অতীতে রাশিয়াও এরদোয়ানকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতোই দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় ডুবে আছেন। তুরস্ক এবং ন্যাটোর অন্য সদস্যদের মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব দেখা দিলে সেক্ষেত্রে ক্রেমলিনকেই বেশি সুবিধাজনক মনে করা হয়।
বিশ্বজুড়ে অনেক সংঘাত জিঁইয়ে রয়েছে : যেসব স্থানে যুদ্ধ চলছে না, কিন্তু দীর্ঘদিনের পুরনো উত্তেজনার সমাধান হয়নি, সেসব জায়গায় ঐতিহাসিক অথবা আঞ্চলিক দুর্দশা চরম। জিঁইয়ে থাকা সংঘাতের সমস্যা হলো তা যেকোনও মুহূর্তে চরম আকার ধারণ করতে পারে। যে বিশ্বে গণতান্ত্রিক পরাশক্তি বিদ্বেষপূর্ণ, ক্ষয়িষ্ণু এবং বিভ্রান্তিকর; সেখানে যুদ্ধ এড়ানো অত্যন্ত কঠিন।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট।
এসআইএস/পিআর