করোনায় রূপ হারিয়েছে দৌলতদিয়া
সদর গেট হয়ে সোজা চলে যাওয়া যায় পল্লীর অন্দরমহলে। কোনো বাধা নেই। প্রবেশ ফি নেই। যেন আপনার আগমনকে স্বাগত জানাতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন নানা বয়সী নারী যৌনকর্মী। প্রবেশপথের অগ্রভাগেই চলে আসেন তারা। অথচ করোনা মহামারি শুরুর আগে ঠিক এমন ছিল না।
আগে পল্লীর কেন্দ্রভাগেই অবস্থান করতেন যৌনকর্মীরা। সেখান থেকেই খদ্দেরে নজর ফেলতেন। অথচ এখন প্রবেশমুখ থেকেই খদ্দের নিয়ে টানাটানি। চৌকিও চোখে পড়বে না এখানকার কোনো প্রবেশপথে। আগে চেয়ার পেতে প্রতিজন খদ্দের বা দর্শনার্থীর কাছ থেকে ৪০ টাকা ফি আদায় করা হতো।
১০ বছর আগেও ফি আদায়ের বালাই ছিল না। পাঁচ টাকা থেকে শুরু হয়ে গত বছর ৪০ টাকা পর্যন্ত প্রবেশ ফি আদায় হতো এই যৌনপল্লীতে। দেশের অন্য যৌনপল্লীতেও কোনো প্রবেশ ফি নিতে দেখা যায় না সাধারণত। মূলত এই পল্লীর ব্যাপকতা আর দর্শনার্থীদের সমাগম সামাল দিতেই ফি আদায় করা হয় বলা জানা যায়। অভিযোগ আছে, প্রবেশ ফি’র অধিকাংশই চলে যেত পল্লী পরিচালনা কমিটি আর পুলিশের পকেটে।
মাত্র আট মাসের ব্যবধানেই বদলে গেছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ এই যৌনপল্লীর রূপ। করোনার ধাক্কায় প্রায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া পল্লী পাঁচ মাস শ্রীহীন ছিল। লকডাউনের পুরো সময় বন্ধ ছিল দৌলতদিয়া যৌনপল্লী। বাঁশ বেঁধে আটকে দেয়া হয়েছিল সবকটি প্রবেশপথ। বাইরে থেকে কেউ প্রবেশ করতে পারেনি। যৌনকর্মীদের অনেকেই পল্লী ছেড়ে চলে যায় বাড়িতে, কেউ বা অন্যত্র। যাদের এই নিষিদ্ধ গলিই ঠিকানা তারাই কেবল রয়ে যায়।
লকডাউন তুলে দেয়ার পর থেকেই স্বাভাবিকতা ফিরতে থাকে, তবে তা আগের রূপে নয়। জীবন-জীবিকার তাগিদে অনেকেই ফিরে এসেছেন পল্লীতে। আগের জৌলুস আর মিলছে না। নানাভাবেই খদ্দের টানার চেষ্টা চলছে। প্রবেশ ফি নেয়া হচ্ছে না ঠিক একই কারণে। দালাল-পাচারকারীদের মাধ্যমে নতুন নতুন মেয়ে আনা হচ্ছে। তবুও আগের মতো মিলছে না খদ্দের। রেটও (পারিশ্রমিক) কমিয়েছেন অনেক কর্মী। ঘরভাড়াও কমেছে কিছুটা। কিন্তু তাতেও ঘরে নিতে পারছেন না খদ্দেরকে। মূলত খদ্দের সংকটে ভুগছেন এ পাড়ার নারীরা। দেড় হাজার যৌনকর্মীসহ এখানে পাঁচ সহস্রাধিক মানুষের বাস। প্রায় সবাই নির্ভর করেন নারীর এই আদি পেশার ওপর।
লকডাউনের সময় পল্লীতেই অবস্থান করছিলেন লাবণ্য। জন্ম এ পল্লীতেই। নানি-মায়ের হাত ধরে ১৪ বছর বয়স থেকেই এ পথে পা রাখে। মা থাকেন এখন পাশের গ্রামে। বলেন, ‘লকডাউনের সময় কোনো আয় হয়নি ঠিক, কিন্তু খেয়ে-পরে বাঁচতে পেরেছি। চাল-ডালসহ প্রচুর সাহায্য পেয়েছিলাম। সেখান থেকে মাকেও দিতে পেরেছি। কিন্তু সমস্যা এখন তীব্র। লকডাউন খুলে দিয়েছে। কিন্তু খদ্দের আর আগের মতো মিলছে না। আবার ত্রাণও মিলছে না। চেনা মানুষ যারা আসেন তারাও অচেনা আচরণ করছেন। কী করব, কূল পাচ্ছি না।’
বেঁচে থাকার আকুতি আরেক মধ্যবয়সী নারী নাসিমারও। তিনি বলেন, ‘এ অভিশপ্ত জীবন নিয়া তো আর বাইরে যাইবার উপায় নাই। ঋণ করে ঘরভাড়া দিছি। রোজ কিস্তি। অথচ কামাই (আয়) নাই। খদ্দের আইব কই থেকে! পকেটে তো টাকা নাই। যারা আহেন, তারা ঘোরাঘুরি কইরাই চইলা যায়। ঘরে আর যায় না। হয়তো না খাইয়াই মরতে অইব।’
দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর করোনাকালীন পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় গোয়ালন্দ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল্লাহ আল তায়াবীরের সঙ্গে। তিনি বলেন, “তৃণমূল এই জনগোষ্ঠীর মানুষের জন্য লকডাউনে পর্যাপ্ত সহযোগিতা করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ দেয়া হয়েছে। পুলিশের ডিআইজি হাবিবুর রহমান স্যার ‘উত্তরণ ফাউন্ডেশনে’র পক্ষ থেকে ১ হাজার ৩০০ যৌনকর্মীকে কয়েক দফায় ৭০ কেজি করে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দিয়েছেন।”
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, গ্লাভসসহ বিভিন্ন সামগ্রী প্রদান করা হয় যৌনকর্মীদের মাঝে। বর্তমান সংকট নিয়ে আসলে কিছু তো করার নেই। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপরও তাদের নির্ভর করতে হয়। এ পেশা থেকে অনেকেই চলে যেতে চাইছেন। দরকার সঠিক পুনর্বাসনের নিশ্চয়তা।’
এএসএস/বিএ/জেআইএম