যে কারণে দল বাঁধে পঙ্গপাল

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:২২ এএম, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০

করোনায় গোটা বিশ্ব যখন আক্রান্ত, তখনই পঙ্গপালের দল ঢুকে পড়ে ভারতের পশ্চিম প্রান্ত থেকে উত্তরপ্রদেশ পর্যন্ত। ফলে জরুরি সতর্কতা জারি করা হয় পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। সে বিপদ আপাতত কমানো গেলেও অদূর ভবিষ্যতে আবারও ধেয়ে আসতে পারে পঙ্গপাল বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সমুদ্রের পানি ক্রমশ উষ্ণ হচ্ছে এবং তাতে বাড়ছে সাইক্লোন বা অতিবৃষ্টির মতো দুর্যোগ। অসময়ের অতিবৃষ্টি পঙ্গপালের বংশবৃদ্ধি আচমকাই বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা ছারখার করছে আশপাশের খেতের ফসল। কাজেই ভবিষ্যতেও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বৃষ্টিপাতের সঙ্গে বাড়বে পঙ্গপালের আক্রমণও।

চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের গবেষণায় জানা গেছে পঙ্গপালের জীবনচক্র। সেই খবর শোনার আগে জেনে নেয়া যাক পঙ্গপালের জীবনচক্র।

ডিম থেকে লার্ভা হয়ে পূর্ণাঙ্গ হওয়ার পথে পঙ্গপাল দুইভাবে থাকতে পারে— একক এবং দলবদ্ধ ভাবে। একক পঙ্গপাল ক্ষতিকর নয়। তবে গরমের সময় কয়েকটি একক পঙ্গপাল দলবদ্ধভাবে থাকতে থাকতে এদের শরীরে সেরাটোনিন নামের এক হরমোন নিঃসৃত হয়। সেরাটোনিন হলো সেই হরমোন, যা মানুষের মানসিক স্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। হরমোন নিঃসরণের পরে পঙ্গপালের মধ্যে একটা সামাজিক ব্যবহারের লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। এরা দল বেঁধে থাকতে এবং প্রচুর খাবার খেতে শুরু করে। এই সময় যদি বৃষ্টি হয়, তখন ভেজা মাটি এবং সবুজ গাছপালা পেয়ে পঙ্গপালরা বিপুল হারে বংশবিস্তার শুরু করে। একক থেকে দলবদ্ধ হওয়ার সময় পঙ্গপালের দেহের রং সবুজ থেকে হলদেটে বাদামি হয়ে যায়। তারই সঙ্গে দেহের বিভিন্ন পেশিও শক্তিশালী হতে শুরু করে। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে বংশবিস্তারের হার এবং খাদ্য গ্রহণের ক্ষমতা।

দলবদ্ধ পঙ্গপালের শরীর এবং বর্জ্য পদার্থ থেকে নিঃসৃত মোট ছয় ধরনের রাসায়নিক চিহ্নিত করেন বিজ্ঞানী লি ক্যাং এবং ওয়াং-এর নেতৃত্বে আটজন গবেষকের দলটি। এর পর ছয়টি আলাদা বাক্সে ছয়টি রাসায়নিক দিয়ে পঙ্গপাল ছেড়ে দেয়া হয়। দেখা যায়, ৪-মিথক্সি স্টাইরিন বা ৪-ভিনাইলানিসোল নামের এক কেমিক্যাল একক পঙ্গপালের চরিত্র বদলে দিয়ে তাদের দলবদ্ধ করছে। এই বিশেষ রাসায়নিক বা ফেরোমন পঙ্গপালের দেহের প্রায় সমস্ত জায়গা থেকেই নিঃসৃত হয়।

ঠিক কয়টি পতঙ্গ কাছাকাছি এলে দলবদ্ধকরণ শুরু হয়? বিজ্ঞানীরা তা জানার জন্য ৪-মিথক্সি স্টাইরিন-এর সঙ্গে নানা সংখ্যার পঙ্গপাল রেখে তাদের ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করেন। মাত্র চার থেকে পাঁচটি পঙ্গপাল কাছাকাছি এলেই তারা শরীর থেকে ৪-মিথক্সি স্টাইরিন নামক ফেরোমন নিঃসরণ এবং দলবদ্ধ হতে শুরু করে। পঙ্গপালের কাছাকাছি হওয়ার মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই ফেরোমন তাদের শরীরে তৈরি হতে এবং ৭২ ঘণ্টার মধ্যে নিঃসরণের মাত্রা সাঙ্ঘাতিক রকমের বেড়ে যায়।

দেখা গেছে, লার্ভা বা পূর্ণাঙ্গ, পুরুষ বা নারী, যে কোনও ধরনের পঙ্গপাল এই ফেরোমনের গন্ধে দলবদ্ধ হতে শুরু করে।

গবেষণা এখানেই থামাননি। তারা এর পর দেখতে চেয়েছেন, এই ফেরোমনের সঙ্গে পঙ্গপালের ঘ্রাণেন্দ্রিয় কীভাবে সম্পর্কযুক্ত। তারা খুঁজে বের করেছেন, সেই পঙ্গপালের অ্যান্টেনায় থাকা গ্রাহক প্রোটিনটিকে, যা কিনা বাতাসে ভাসমান ৪-মিথক্সি স্টাইরিনের সঙ্গে যুক্ত হয়। নাম ওআর৩৫। রিসেপটরগুলি এর পরে বিশেষ কোষগুচ্ছকে উত্তেজিত করে। ফল ফেরোমন নিঃসরণ। পরীক্ষাগারে জিন প্রযুক্তির সাহায্যে এমন ধরনের পঙ্গপাল বানানো হয়েছে, যার ওআর৩৫ প্রোটিনটি অকেজো। এদের দল পাকানোর ক্ষমতা একেবারেই কমে গিয়েছে কি-না, তার ওপর পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। এ রকম যদি কোনও রাসায়নিক পদার্থ খুঁজে পাওয়া যায়, যা পঙ্গপালের এই রিসেপটর প্রোটিনটিকে ব্লক করে দেবে, সে ক্ষেত্রে পঙ্গপালের ঘ্রাণক্ষমতা একেবারেই কমে যাবে।

যে কারণে আবিষ্কারটি গুরুত্বপূর্ণ
প্রথমত, পঙ্গপালের ঝাঁক সামলাতে কীটনাশক স্প্রে করলেও সফলভাবে দমন মুশকিল। কারণ এরা অত্যন্ত দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে। সদ্য আবিষ্কৃত ফেরোমনটিকে ল্যাবে কৃত্রিমভাবে তৈরি করে ফেরোমন ট্র্যাপের মাধ্যমে পঙ্গপালের ঝাঁককে আকৃষ্ট করে একসঙ্গে অসংখ্য পঙ্গপাল নিধন করা সম্ভব।

কলকাতার পতঙ্গবিদ সায়ন্তন ঘোষের মতে, এ আবিষ্কার চাষিদের জন্য সুখবর আনতে চলেছে। তার বক্তব্য, কীটনাশকের সাহায্যে পঙ্গপাল মারার প্রক্রিয়ায় অনেক বন্ধু পোকাও মারা যায়। এ আবিষ্কারের ফলে অদূর ভবিষ্যতে পঙ্গপালের দলকে খুব ছোট জায়গায় এনে কীটনাশক প্রয়োগে মারা যাবে। ফলে প্রকৃতির ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, এ ফেরোমন পঙ্গপাল চিনতে পারে গন্ধের মাধ্যমে। বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যে, খুব শিগগিরই অ্যান্টি-কেমিক্যাল আবিষ্কার করা সম্ভব, যা ফেরোমন কাজ করার আগেই পঙ্গপালের ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে আটকে দেবে। তৃতীয়ত, প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, পঙ্গপালরা একে অপরের পিছনের পায়ে স্পর্শ করে দল বাঁধে। কিন্তু তা যে আসলে ঘ্রাণ-নির্ভর, তা এই গবেষণা থেকে পরিষ্কার হয়েছে।

একটি পঙ্গপালের ঝাঁক প্রায় ৫০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে থাকতে পারে এবং দিনে ১০০ কিলোমিটার অবধি উড়তে পারে। এর সঙ্গে দিনে প্রায় দেড় লক্ষ টন পরিমাণ খাদ্যশস্য ধ্বংস করে। এই পঙ্গপাল শুধুমাত্র আফ্রিকা বা ভারত অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। পরবর্তীতে তা আরও এগিয়ে আসবে পূর্ব ভারতের দিকে। যদি পঙ্গপালেরই শরীর-নিঃসৃত এক রাসায়নিক ব্যবহার করে তাকে নিয়ন্ত্রণের উপায় বের করার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে পারে, তখন এই গতিপথ রোধ করা সম্ভব হবে বলেই বিজ্ঞানীদের অনুমান।

এএইচ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।