আমাদের সিনেমা এবং স্বপ্ন ও বাস্তবতা!


প্রকাশিত: ১০:০৮ এএম, ০২ নভেম্বর ২০১৫

এক
একটি ইন্ডাস্ট্রি এগোয় নানা ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে। দেশ এবং সমাজও প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। যখন দেশ স্বাধীন হয়নি তখন সবার মনে ছিলো জাতীয়তাবাদের অনুভব, দেশীয় সিনেমা একটু ভালো হলেও উর্দু আর হিন্দি সিনেমার চেয়ে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা তা নিয়ে গর্ব করেছেন। তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং সবার প্রেরণায় প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশেও আমাদের চলচ্চিত্রকাররা সেরাটা উজার করে দিতে পেরেছেন।

প্রথম সবাক সিনেমা মুখ ও মুখোশ’র পরিচালক আব্দুল জব্বার খানের অনুপ্রেরণায় কিছু অসাধারণ চলচ্চিত্রকারের জন্মও হয় তখন এদেশে। খান আতাউর রহমানের ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’, জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ আমাদের স্বাধীকার, স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশাল ভূমিকা রেখেছিলো। পাশাপাশি সুতরাং, বেহুলা, রূপবানসহ নানা ধরণের সিনেমা মুক্তি পায় যা ‘বাণিজ্য’ সফলতা পায়!

দুই
একটি ইন্ডাস্ট্রিতে সব ধরণের সিনেমা নির্মিত হবার ট্রেন্ড সত্তর এবং আশির দশকে এমনকি নব্বই দশকেও অব্যহত থাকে। স্বাধীনতার পর ‘ওরা এগারজন’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’সহ স্বাধীনতা এবং পরবর্তী বাংলাদেশ নিয়ে বেশ কিছু সিনেমা নির্মিত হয়। দেশীয় নির্মাতাদের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু উপমহাদেশীয় সিনেমা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেন। পচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর সরকারের সাথে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বদলে যেতে শুরু করায় নির্মাতারা ছবির ধরণ বদলে ফেলতে শুরু করেন।

মারদাঙ্গা, ফ্যান্টাসি, সামাজিক, রোমান্টিক সিনেমার সংখ্যা বাড়তে থাকে। দীর্ঘ সামরিক শাসনেও অধিকার, রাজনৈতিক চেতনা বলতে গেলে অবরুদ্ধই থেকেছে। এর মাঝেও কিছু নির্মাতা সুকৌশলে সময়ের কথা, স্বাধীনতার কথা, যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বলতে চেষ্টা করেছেন।

পাশাপাশি সাহিত্যনির্ভর সিনেমার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন বাণিজ্যিক ছবির প্রযোজকেরা। একদিকে আবেহায়াত, নরম গরম’র মতো মশলা ছবি আবার অন্যদিকে দেবদাস, নয়নমনি, পরিণীতা, চাপাডাঙার বৌ’র মতো সাহিত্য ও গল্প নির্ভর সিনেমা নির্মিত হয়েছে। দর্শক দুটি ধারাকেই ভালোবেসেছিলেন।

বিভিন্ন প্রজন্মে ঢাকাই ছবি আলমগীর কবির, আমজাদ হোসেন, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, কাজী জহির, দীলিপ বিশ্বাস, চাষী নজরুল ইসলাম, আজিজুর রহমান, জহিরুল হক, কাজী হায়াত, শিবলী সাদিক, মহম্মদ হাননান, মতিন রহমান, মালেক আফসারী, শহীদুল ইসলাম খোকন, মাসুদ পারভেজ, রাজ্জাক, বুলবুল আহমেদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, হুমায়ূন আহমেদ, তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলামের মতো খ্যাতিমান ও সুনির্মাতাদের জন্ম দিয়েছে এবং দর্শকদের ধন্য করেছে।

বাণিজ্যিক সিনেমা প্রদর্শন করে প্রযোজকরা ইউনিট আর হলের ক্ষুধা মিটিয়েছেন। একইভাবে নান্দনিক সিনেমা দিয়ে ক্ষুধা মিটেছে মন আর মেধার। কেউ কোনো কাঁদা ছোড়াছুড়ি বা বিভাজনে ছিলেন না।

তিন
পুঁজিবাদের হাওয়া, বিশ্বায়নের ঢেউ মানুষের চোখ খুলে দেয়। তাদের কাছে অধিকার মুখ্য হয়ে পড়ে। দেশীয় কাপড়ের দাম বেশি তাই পাকিস্তানি, ভারতীয় কাপড় কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন অনেকেই। দেশীয় কাপড়ের দাম কেন বেশি এবং কি কি পদক্ষেপ নিলে দেশেই কমমূল্যে ভালো মানের কাপড় দেয়া যেতে পারে এটি নিয়ে ভাবার মানুষ কমে যায়। আমাদের ১ কোটি টাকার সিনেমা কেন বলিউডি ১০০ কোটি টাকার সিনেমার মতো হয়না(!) এটি নিয়ে সমাজে বিস্তর সমালোচনা এবং ঠাট্টা শুরু হতে থাকে।

স্যাটেলাইট চ্যানেলের আগমন এবং এতে সিনেমা প্রদর্শন, টিভি প্রিমিয়ারে সিনেমাহলে দর্শক কমতে শুরু করে। সিনেমার ধ্বসে একদল প্রযোজক অশ্লীল সিনেমা নির্মাণ শুরু করে। সেইসাথে ‘বিভাজন’নীতি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকে পড়ে। ঢালাওভাবে কিছু মিডিয়াও মূল সমস্যা চিহ্নিত এবং সমাধানের চেয়ে বাণিজ্যিক সিনেমার প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পেশাগত ও ব্যক্তিগতভাবে হেয় করা শুরু করে। সিনেমার সংকট হয় বহুমুখী!!

বিনিয়োগের অভাবে বাণিজ্যিক সিনেমা নির্মাণ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে পরিবর্তনের স্লোগান নিয়ে আসা নতুনধারার সিনেমাগুলো মিডিয়া আর উৎসব দাপালেও হল সচল রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। ঠিক এ সময়ে সিনেমাহল চালু রাখার নামে ‘সিনেমা আমদানি’র প্রক্রিয়া শুরু হয় আবারো।

সমাজ ও মিডিয়ার এমন ‘কিছু’ মানুষ ‘আমদানি’র পক্ষে বলতে শুরু করেন যারা কোনোদিন জানতেও চাননি ‘আমাদের’ সিনেমা কেন পিছিয়ে পড়েছে বা ‘কোনো’ করণীয় আছে কিনা। চলচ্চিত্রকর্মীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপমহাদেশীয় সিনেমা আমদানি স্থগিত করেন। কিন্তু প্রচেষ্টা নানা মোড়কে অব্যহত  থেকেই গিয়েছে।

চার
আসেন গৌতম ঘোষ, প্রসেনজিত ও তাদের দল। আসেন মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তার দল। আসেন মুকেশ ভাট, রমেশ সিপ্পি ও তাদের দল। সবখানেই বিশেষ করে আমাদের সিনেমার প্রদর্শকদের সহাস্য উপস্থিতি! তাদের চাই মুনাফা আর মুনাফা! এখন সময় খারাপ তাই দরকার উপমহাদেশীয় সিনেমা। এগুলোও না চললে আরো কিছু চাইতেই থাকবেন কিন্তু হল সংস্কার করবেন না!

‘কাফন’ খুলে কিছু শিল্পী, কুশলী এমনকি নাটকের, গানের মানুষেরাও অতি সম্প্রতি এই কলরবে যোগ দিয়েছেন।
আমদানি শুনতে খারাপ লাগেতো তাই যৌথ প্রযোজনা। ওটাকেও কেউ প্রতারণা বলে ফেললে বিনিময়। আচ্ছা এতেও সমস্যা? তাহলে ‘বলিউড’ যাবে ঢাকার ছবি? এই ‘মরীচিকা’য় শখানেক সেলফি!!!! আচ্ছা কাফনের কাপড়গুলো এখন কোথায়?

বিশেষ কিছু কথা
১. দেশে কোনো ফিল্ম ফিন্যান্সিং ফান্ড নেই কাজেই প্রযোজকের নিয়ত ও সামর্থ্য শেষ কথা। এমনকি কোনো বাজে চক্র বিনিয়োগ করলেও কোনো মনিটরিং এবং এড়ানোর উপায় নেই। মনে রাখবেন সিনেমা ন্যুনতম কোটি টাকার বিষয়।
২. ফিল্ম ইন্সটিটিউট হয়েছে অতিসম্প্রতি। এর ফল পাওয়া অনেক দূর। তাই গুরুর কাছে শেখা চলছে এখনো।
৩. ফিল্মসিটি কবিরপুর, এফডিসির আধুনিকায়ন চলছেইইইই!
৪. ভালো সিনেমা কাগজ দাপালেও দর্শক আনুকূল্য পায়না আবার হলমালিকেরা সব ছবি চালাতেও চাননা। সবশেষ উদাহরণ গাড়িওয়ালা। উৎসবে যাবার আগে নির্মাতা স্যান্ডেল ক্ষয় করেও হল পাননি। প্রয়াত তারেক মাসুদকে বিকল্প পদ্ধতিতে প্রদর্শনের কথা ভাবতে হয়েছে। অর্থাৎ ভালো দর্শক, প্রদর্শক ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে।
৫. কিছু মানুষ আছে যারা বাণিজ্যিক সিনেমার দোষ নিয়ে ব্যস্ত কিন্তু কার্যত নিজেদের কোনো সাফল্য নেই। সিনেমা যেহেতু যে কেউ বানাতে পারে এতে নিজের সাফল্য না খুঁজে অন্যদের নিয়ে টানাটানির হেতু কী বোঝা যায়না।
৬. বলিউড বা কলকাতার কোন নায়িকার পা পিছলে গেলো, বলিউডে নতুন কি সিনেমা এলো সেটার ডিটেইল-এ কিছু মিডিয়ার যে আগ্রহ তার এক দশমাংশও দেশের সিনেমা ও তারকারা পান কিনা সন্দেহ। এরা অজুহাত হিসেবে একদিকে এদের দর্শকপ্রিয়তার কথা বলে আবার দেশীয় দর্শকপ্রিয় সিনেমার তারকাদের নিয়ে পারলে স্যাটায়ারও করে।
৭. সমাজে কিছু মানুষ আরো বেড়েছে এদের বাংলাদেশের কিছুই ভালো লাগেনা। সিনেমার সীমাবদ্ধতা জানতেও চায়না। কেউ জেনেও না জানার ভান করেন।
৮. সিনেমাহল সংস্কার হচ্ছেনা।
৯. নির্মাতারা কি ছবি বানাবেন?
- রানা প্লাজা ধরণের বিষয় আদৌ মুক্তি পাবে কীনা সন্দিহান
- মুক্তিযুদ্ধ বা জাতীয় বীরদের নিয়ে সিনেমা বানাতে পারবেন না কখন সরকার পরিবর্তন হয়ে যায় এই ভয়ে। এসব ইস্যুতে এখনও ঐকমত নেই!!!
- কোনো বাহিনী বা পুলিশ নিয়েও কোনো কাহিনী ঝুকিপূর্ণ!
- জঙ্গিবাদ, যুদ্ধাপরাধের বিচার, নব্য ক্লাইভ বা আন্তর্জাতিক কোনো বিষয় নিয়ে সিনেমা বানাতে যে বিনিয়োগ বা অনুকুল পরিবেশ দরকার তা আছে কী?
- ভারতের সিনেমায় বাজারের কথা মাথায় রেখে অনেক নায়ক এবং প্রধান চরিত্র মুসলমান দেখানো হয় এবং নিয়মিতভাবে তাদের গানে খোদা, আল্লাহ বেশ ব্যবহৃত হয়। এদেশে হিন্দু বা অন্য ধর্মকে এমন ভাবে উপস্থাপনের কোনো পরিবেশ আছে বলে মনে হয়না।

শেষকথা
উপমহাদেশীয় সিনেমা প্রদর্শন শুরু হলে উপরের কোনো সমস্যার সমাধান হবে বলে আমি অন্তত মনে করিনা। তাই আগে ভালো সিনেমার পরিবেশ তৈরি বেশি জরুরি।

[লেখক : প্রাক্তন নির্বাহী সম্পাদক আনন্দভুবন, প্রাক্তন নির্বাহী সম্পাদক আনন্দ আলো / মিডিয়া কনসালটেন্ট সুপারহিরো সুপারহিরোইন ২০০৯ . জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান ২০১০ /টেলিভিশন অনুষ্ঠান পরিকল্পক ও উপস্হাপক / বর্তমানে এশিয়ান টিভিতে অনুষ্ঠান প্রধান(অতি:) হিসেবে কর্মরত / বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি(বাচসাস) এর গবেষণা ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ]

এলএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।