ট্রাম্প নাকি বাইডেন, ক্ষমতায় কাকে দেখতে চায় চীন?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছুদিন আগে দাবি করেছেন, আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন জিতলে যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানা চীনের হাতে চলে যাবে এবং আমেরিকানদের বাধ্য হয়ে চীনা ভাষা শিখতে হবে। ডেমোক্র্যাটরা চীনের প্রতি দুর্বল এ কথা গত চার বছর ধরেই বলে আসছে রিপাবলিকানরা। এবার নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হতেই আবারও সেই চীনবিরোধী সুর তুলেছে ক্ষমতাসীনরা।
চলতি সপ্তাহের দলীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি। এতে ১০টি প্রধান প্রতিশ্রুতি তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে চাকরি এবং করোনা নির্মূলের পরেই রয়েছে চীননির্ভরতা শেষ করার প্রতিশ্রুতি।
ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় বলা হচ্ছে, তারা চীন থেকে প্রস্তুতকারক খাতের ১০ লাখ চাকরি ফিরিয়ে আনবেন এবং বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ায় দেশটিকে পুরোপুরি দায়ী করা হবে।
ট্রাম্প নাকি বাইডেন?
ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে প্রবেশের পর কয়েক দশকের মধ্যে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে। চীনের বিরুদ্ধে শুল্কযুদ্ধ শুরু করেছেন ট্রাম্প, নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন চীনা কর্মকর্তাদের ওপর, তাইওয়ানকে সমর্থন জানিয়ে বিরাগভাজন হয়েছেন বেইজিংয়ের, টেক জায়ান্ট হুয়াওয়েসহ চীনা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে নিষিদ্ধও করেছেন।
ফলে ওয়াশিংটনের অনেকেই মনে করছেন, চীনের নেতারা ট্রাম্পের চেয়ে বাইডেনকেই হোয়াইট হাউসে দেখলে বেশি খুশি হবেন। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা উইলিয়াম এভানিনা এক বিবৃতিতে বলেছেন, বেইজিং চাচ্ছে ট্রাম্প এবারের নির্বাচনে হারুক।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তব পরিস্থিতি প্রকৃতপক্ষে বেশ জটিল। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রার্থী ভালো হবেন তা নিয়ে এখনও দ্বিধাবিভক্ত চীনা নেতারা।
বেইজিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী জোট এবং আন্তর্জাতিক সুনামের ক্ষতি করেছেন। করোনায় দেশটিতে পৌনে দুই লাখ মানুষের মৃত্যুকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়া এবং বৈশ্বিক নেতৃত্ব সংকটের লক্ষণ বলে প্রচার করছে চীন।
ট্রাম্পও একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আর শুল্কবাণে জর্জরিত করেছেন চীনকে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এসব উদ্যোগের বেশিরভাগই ছিল একপাক্ষিক, অর্থাৎ পুরোনো মিত্ররা এক্ষেত্রে তাদের সমর্থন করেনি।
চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক জাতীয় কমিটির সভাপতি স্টিফেন অরলিন্স বলেন, ‘তারা জানে বাইডেন বহুপক্ষীয় হবেন; তা সেটা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই হোক বা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বা মানবাধিকারে। চীনের প্রতি এবং যারা বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার বিষয়ে ভীত তাদের প্রতি তার বহুপক্ষীয় দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে।’
ক্লেয়ারমন্ট ম্যাকেনা কলেজের অধ্যাপক মিনজিন পেইয়ের মতে, বাইডেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো বহুপক্ষীয় সংস্থাগুলোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পুনর্বহাল করবেন, পাশাপাশি বাণিজ্য এবং ন্যাটোর সামরিক জোট শক্তিশালী করবেন- যেগুলোর মাধ্যমে চীনকে আটকানো যাবে।
বাইডেনের অবস্থান কী?
বিশ্লেষকরা বাইডেনকে অনেকটা উদারপন্থী বললেও তার কথায় তেমনটা মনে হওয়ার কোনও কারণ নেই। যদিও গত সপ্তাহে ডেমেক্র্যাটদের দলীয় সম্মেলনের ভাষণে মাত্র একবার চীনের নাম উচ্চারণ করেছেন বর্ষীয়ান এ নেতা। তবে তিনি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে ‘দুর্বৃত্ত’ বলে মন্তব্য করেছেন এবং ডেমোক্র্যাটদের নির্বাচনী প্রচারণতেও বলা হচ্ছে, ট্রাম্প করোনা মহামারির জন্য চীনকে ঠিকভাবে দায়ী করেননি।
ডেমোক্র্যাটদের ৯২ পাতার ইশতেহারে স্বাস্থ্যসেবা, জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি চীনের কথা বলা হয়েছে মোট ২২ বার। এ নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে, চীন বা যেকোনও দেশ যারাই আমেরিকান উৎপাদন কমিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে কীভাবে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে। চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে মিত্রদের সঙ্গে কাজ করা এবং জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুরসহ অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়নের প্রতিবাদ এবং হংকংয়ের সার্বভৌমত্ব ছিনতাইয়ে দায়ীদের ওপর নিষেধাজ্ঞার কথাও রয়েছে এতে।
অননুমেয় ট্রাম্প
বাইডেনের প্রেসিডেন্ট পদ বেইজিংয়ের জন্য যেমন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তেমনি ট্রাম্পের অস্থিরতার কারণেও কপালে ভাঁজ পড়ছে চীনা নেতাদের।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার শুরুর দিকে জিনপিংয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন ট্রাম্প। ফ্লোরিডায় নিজস্ব বিলাসবহুল রিসোর্টে নিয়ে একসঙ্গে খাবার খেয়েছেন; মুখে বহুবার বলেছেন, তারা একে অপরকে কতটা ভালোবাসেন, কত ভালো বন্ধু তারা! অথচ এমন ‘মিষ্টি সম্পর্কের’ মধ্যেই আবার কড়া হুমকিও দিয়েছেন চীনকে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ ধরনের অনিশ্চয়তা দুই পক্ষের মধ্যে সামরিক ঝুঁকি বৃদ্ধির শঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ক্লিনটন প্রশাসনের সাবেক উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুজান শায়ার্ক বলেন, ‘চীনের সঙ্গে আমাদের ভালো যোগাযোগ এবং সংকট প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেই, যেমনটা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধের সময়।’
তিনি বলেন, ‘চীন অর্থনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে অন্যান্য দেশকে চীনা লাইন সমর্থনে বাধ্য করায় এশিয়ার অনেক বন্ধু হারিয়েছে। যদি বাইডেন প্রশাসন হয়, (যুক্তরাষ্ট্রের জন্য) এশিয়ায় একটি শক্তিশালী জোট গঠন অনেক সহজ হবে।’
চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমও ট্রাম্পের চেয়ে বাইডেনকে মোকাবিলা বেশি সহজ হবে বলে উল্লেখ করেছে। চীনা মন্ত্রিসভার অন্যতম উপদেষ্টা হেনরি ওয়াং বলেছেন, বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গেই তাদের আলোচনার সুযোগ বেশি থাকবে।
সূত্র: সিএনএন
কেএএ/জেআইএম