বৈরুত বিস্ফোরণের আগে নেতানিয়াহুর টুইট, জল্পনা তুঙ্গে
অডিও শুনুন
মঙ্গলবারের বিস্ফোরণ লেবাননের রাজধানী বৈরুতে মৃত্যু এবং ধ্বংস ডেকে এনেছে। বিস্ফোরণের উৎস ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছেয়ে যাচ্ছে নানা ধরনের জল্পনা ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বে। বৈরুতের বন্দরের কাছে একটি গুদামে অবৈধভাবে মজুত করে রাখা ২ হাজার ৭০০ টনের অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে এখন পর্যন্ত লেবাননের সরকার ধারণা করছে। ২০১৩ সালের পর থেকে উচ্চমাত্রার এসব বিস্ফোরক বৈরুতের গুদামে কোনও ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই মজুত ছিল।
বিস্ফোরণের উৎস নিয়ে দেশটির সরকারের এ ধারণার সঙ্গে অনেকেই ভিন্নমত পোষণ করে বিকল্প ব্যাখ্যা হাজির করছেন। বৈরুতের এই বিস্ফোরণ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি আলোচিত পাঁচটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।
Tweet of Israel's P.M.
—Aqeel αhmαd kh عقیل احمد خان (@AqeelAhmad092) August 5, 2020
before #BeirutBlast
Something is wrong pic.twitter.com/PBJbEpvrGI
এক. ইসরায়েলি হামলা
বিস্ফোরণের পরপরই বেশকিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করছেন। বিস্ফোরণের আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর একটি টুইট ঘিরে এই জল্পনা আরও জোরাল হয়েছে।
মঙ্গলবার ইসরায়েলের রামলি শহরে দেশটির সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটি পরিদর্শনের পরপর এক টুইট বার্তায় সতর্ক করে দিয়ে নেতানিয়াহু বলেন, আমরা আস্তানায় আঘাত করি এবং এখন প্রেরণাদানকারীদের আঘাত করছি। আত্মরক্ষার জন্য আমরা প্রয়োজনীয় সবকিছুই করবো। আমি হিজবুল্লাহসহ তাদের সবাইকে বিষয়টি বিবেচনার পরামর্শ দিচ্ছি।
ইসরায়েলি এই প্রধানমন্ত্রী দেশটির সেনাবাহিনী গত সোমবার অধিকৃত গোলান উপত্যকায় সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর হামলা ঠেকিয়েছে বলে দাবি করেন। টুইটে তিনি বলেন, এসব নিরর্থক কোনও কথা নয়। ইসরায়েল রাষ্ট্রের ওজন আছে এবং এটার পেছনে আছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী। এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া উচিত।
দামেস্কের উপকণ্ঠে ইসরায়েলি বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর একজন যোদ্ধা নিহত হওয়ার পর ওই এলাকায় সৃষ্ট উত্তেজনার মাঝে নেতানিয়াহু এসব মন্তব্য করেন। বৈরুতে হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে ইসরায়েলের হামলার ব্যাপারে যদিও তেমন শক্তিশালী কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তারপরও নেতানিয়াহুর টুইটের ‘সময়’ বিবেচনা করে অনেকেই তেলআবিব বৈরুতের বিস্ফোরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে অভিযোগ করছেন।
তবে ইসরায়েলে সামরিক বাহিনীর একটি সূত্র বৈরুতে হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, এটা নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কোনও ঘটনা নয়। অন্যদিকে, ইসরায়েলের চিরবৈরী শত্রু হিসেবে পরিচিত ইরানও বৈরুত বিস্ফোরণের সঙ্গে তেলআবিবের জড়িত থাকার ধারণা নাকচ করে দিয়েছে।
Israeli military sources tell Israeli 10 News reporter: Israel didn't bomb Beirut. The explosion did not occur in a Hezbollah weapons depot. This was not a security-related event. https://t.co/hgDXFVxZdH
— Elizabeth Tsurkov (@Elizrael) August 4, 2020
বিস্ফোরণের পরপরই লেবাননকে মেডিকেল ও মানবিক সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। একই সঙ্গে বিস্ফোরণে হতাহতদের প্রতি শোক ও শ্রদ্ধা জানাতে তেলআবিবের পৌর ভবন আলোকসজ্জায় আলোকিত করার ঘোষণা দেয়।
যদিও লেবাননে সহায়তা পাঠানোর ঘোষণা দিয়ে ইসরায়েল প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে বলে কিছু পর্যবেক্ষক সমালোচনা করেছেন।
দুই. হিজবুল্লাহর সংশ্লিষ্টতা
এদিকে কিছু কিছু তাত্ত্বিক বৈরুতে হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করছেন। তবে অন্যরা আবার এই বিস্ফোরণ হিজবুল্লাহই ঘটিয়েছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
WATCH:
— Maajid أبو عمّار (@MaajidNawaz) August 5, 2020
Banned terrorist group Hezbollah seemed *very* aware of the now exploded 2750 tonnes of Ammonium Nitrate (often used to make terrorist bombs) sitting at Beirut’s port for 6 years https://t.co/WGuTsfyhw8
২০১৭ সালে হিজবুল্লাহর মহাসচিব হাসান নাসরুল্লাহর ইসরায়েলের হাইফা বন্দরে হামলা চালানোর হুমকির একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওতে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের মাধ্যমে ‘পারমাণবিকের মতো’ বিস্ফোরণ ঘটানোর হুমকি দিয়েছিলেন নাসরুল্লাহ। তার এ হুমকির ভিডিওটি বৈরুত বিস্ফোরণের পর ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
এছাড়া অনেকেই ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরের একটি পুরোনো টুইট শেয়ার করছেন। এই টুইটে ইরান এবং হিজবুল্লাহর একটি ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পের কিছু ছবি প্রকাশ করে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী।
এসব ভিডিও এবং ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে পুনরায় ছড়িয়ে পড়লেও লেবাননের কর্মকর্তারা বলছেন, বিস্ফোরণের স্থানটি ছিল একটি গুদাম; যেখানে জব্দকৃত রাসায়নিক মজুত ছিল। এটি হিজবুল্লাহর গুদাম ছিল না বলে জানিয়েছেন তারা।
তিন. পারমাণবিক অথবা ক্ষেপণাস্ত্র বোমা
EXPOSED: Iranian and Hezbollah Accurate Missile Project pic.twitter.com/RoiThC8uYJ
— Israel Defense Forces (@IDF) September 27, 2018
যদিও বিস্ফোরণের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত বিস্তারিত কোনও তথ্য প্রকাশ হয়নি তারপরও বিস্ফোরণের সঙ্গে উচ্চমাত্রার রাসায়নিক উপাদানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে অনেকের ধারণা, লেবাননের রাজধানী লক্ষ্য করে বোমা হামলা হয়েছে।
এমন ধারণাকারীদের মধ্যে রয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। বিস্ফোরণের পর হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট বলেন, আমাদের কয়েকজন বিশিষ্ট জেনারেলের সঙ্গে আমি দেখা করেছি এবং তারা ধারণা করছেন- এটা উৎপাদনের মতো কোনও ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা নয়। তিনি বলেন, তাদের মতে এটা হতে পারে কোনও হামলা। আর তারাই আমার চেয়ে ভালো জানেন।
Video show a black object fly toward the site of explosion just before the explosion in #Beirut #Lebanon .
— M IMRAN ARAIN (@imranarainppp) August 4, 2020
It may be a bomb , it may be a guided missile and it may be a black bird ( but size of bird can't be that big as compared to the buildings ) pic.twitter.com/nd074jbD52
তবে ট্রাম্পের এই মন্তব্যের ব্যাপারে লেবানন আপত্তি জানানোর পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দফতরের কর্মকর্তারা প্রেসিডেন্টের ধারণার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।
কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী বিস্ফোরণস্থলের আশপাশের আকাশে কালো কিছু বস্তু ওড়ার ছবি এবং ভিডিও পোস্ট করে সেগুলো ক্ষেপণাস্ত্র হতে পারে বলে মন্তব্য করেন। এই দাবির ব্যাপারে কেউ কেউ উপহাস করছেন। তারা বলছেন, বিস্ফোরণস্থলের আকাশে উড়তে দেখা যাওয়া কালো বস্তুগুলো পাখির ঝাঁক হতে পারে।
ইএসপিএনের সাবেক সংবাদকর্মী ক্রিস পালমারের টুইটারে এক লাখের বেশি ফলোয়ার আছে। এক টুইটে তিনি বলেন, বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থলে মাশরুমের মতো ধোঁয়ার যে কুণ্ডলি দেখা গেছে, তার অর্থ হচ্ছে- এটি একটি আনবিক বোমার বিস্ফোরণ। পরবর্তীতে তিনি এই টুইট ডিলিট করে দিয়েছেন।
#LebanonExplosion it’s conspiracy to occupy Lebanon .. its 1000’s of peoples died.. one could see the people flying due to the waves originated by the blast.. that’s atomic attack and some firework or stored firework explosion .. it’s an attack on human rights violations pic.twitter.com/1jUB262LNk
— rocky (@rockyrock916) August 4, 2020
মিডলবুরি ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ক্ষেপণাস্ত্র বিশেষজ্ঞ জিফ্রে লুইস অনলাইন সংবাদমাধ্যম ভাইসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে আনবিক বোমার এই তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা যারা পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করি, তারা বারবার ব্যাখ্যা করতে পারি যে- এটি পারমাণবিক বিস্ফোরণের মতো কিছুই দেখাচ্ছে না।
চার. তুরস্কের রাসায়নিক
লেবাননের সাধারণ নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান আব্বাস ইব্রাহীম বলেছেন, মঙ্গলবার গুদামে উচ্চমাত্রার রাসায়নিকের বিস্ফোরণ ঘটেছে; যা কয়েক বছর আগে জব্দ করা হয়েছিল। তার এই দাবির পর অনেকেই গুঞ্জন ছড়িয়ে দেন যে, সিরিয়াগামী তুরস্কের একটি জাহাজ থেকে এসব রাসায়নিক বিস্ফোরক দ্রব্য জব্দ করা হয়েছিল। তবে এই দাবিটি সত্য নয়।
The explosive materials were on a Turkish ship, called Fatahullah. In 2014 and during supporting extremists in Syria, this ship was stopped in #Beirut and the materials were stored there. #Turkey again https://t.co/eY8e3HUtXX
— Peace (@SrushtiMin) August 4, 2020
কারণ ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে মলডোভার পতাকাবাহী রাশিয়ার মালিকানাধীন একটি কার্গোতে করে বৈরুতের বন্দরে পৌঁছেছিল ওই বিস্ফোরক দ্রব্য।
পাঁচ. আতশবাজির জল্পনা
3rd video from another angle. Initial reports that explosion occurred due to accidental fire break in fireworks cache #Lebanon #Beirutpic.twitter.com/1WnCO6N0HI
— Hemat (@Himat75) August 4, 2020
প্রথম বিস্ফোরণের পরপরই অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেন, বৈরুতের পূর্বাঞ্চলের বন্দরে আতশবাজির মতো কিছু বারবার জ্বলে উঠছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় বিস্ফোরণ ঘটলে গুঞ্জন আরও বাড়তে থাকে।
লেবানের নিরাপত্তা প্রধান আব্বাস ইব্রাহীম বিস্ফোরণের সঙ্গে আতশবাজির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, আতশবাজি নিয়ে আলোচনা একেবারে হাস্যকর। সেখানে কোনও ধরনের আতশবাজি ছিল না। তবে উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক ছিল।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে বৈরুতের পূর্বাঞ্চলের বন্দরের কাছে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ১৩৭ জন নিহত ও পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়। তবে এই বিস্ফোরণের সঙ্গে কেউ জড়িত কিনা তা এখনও জানা হয়নি।
এসআইএস/জেআইএম