চীন বনাম আমেরিকা: হুয়াওয়ে এবং প্রযুক্তিগত স্নায়ুযুদ্ধ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:৩৬ এএম, ১৭ জুলাই ২০২০

১৯ বছর আগে অপরিচিত এক চীনা প্রতিষ্ঠান ফ্রাঙ্কফুর্টে তাদের প্রথম ইউরোপীয় সেলস অফিস খোলে এবং টেলিকম নেটওয়ার্কের কাজ শুরু করে। ধীরে ধীরে সেই প্রতিষ্ঠানটিই আজ হয়ে উঠেছে চীনের প্রযুক্তিগত উত্থানের প্রতীক; নাম- হুয়াওয়ে। তবে ২০১৮ সাল থেকে এ টেকজায়ান্টের ওপর ক্রমাগত আক্রমণ চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

হুয়াওয়ে নিয়ে প্রযুক্তিগত স্নায়ুযুদ্ধ চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শুরু হলেও সম্প্রতি এতে যোগ দিয়েছে মার্কিনিদের অন্যতম প্রধান মিত্র যুক্তরাজ্য। দেশটিতে হুয়াওয়ের সব ধরনের ৫জি সেবা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোও শিগগিরই একই ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে। তবে পশ্চিমাদের এমন উদ্যোগে কোনও সমাধান নয়, বরং সুসঙ্গত পরিকল্পনার অভাবই ফুটে উঠেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা প্রধান বরাবরই হুয়াওয়ের পণ্যগুলো গুপ্তচরবৃত্তিতে সহায়তার উপযোগী করে নকশা করা এবং এটি গ্রাহকদের চীনা প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে বলে অভিযোগ করেছেন। তবে এসব সমস্যা নিয়ন্ত্রণযোগ্য বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্বের ১৭০টিরও বেশি দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাজ্য ২০১০ সালের দিকে হুয়াওয়ের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে সাইবার-বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি বিশেষ সেল গঠন করে এবং পরে প্রতিষ্ঠানটিকে নেটওয়ার্কের কম গুরুত্বপূর্ণ অংশে সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে নিজেদের স্বার্থরক্ষার পাশাপাশি চীনের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ এবং স্নায়ুযুদ্ধ রোধে মধ্যবর্তী একটি পথ তৈরি হয়। সেসময় অনেক দেশই যুক্তরাজ্যের এ পদক্ষেপ অনুসরণ করে।

তবে এমন চমৎকার একটি সমাধানও একসময় অগ্রাহ্য করা হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্বকে হুয়াওয়ে পণ্য বর্জনের আহ্বান জানিয়ে এর সরবরাহকারীদের ওপর একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এমনকি আমেরিকান সরঞ্জাম ব্যবহার করে বিদেশে তৈরি চিপ বিক্রিতেও বাধা দেয়া হয়েছে। ফলে, সরবরাহকারী নাকি মিত্র- যুক্তরাজ্য কার পক্ষে যাবে তা অনেকটাই অবধারিত হয়ে পড়ে।

দোষ অবশ্য হুয়াওয়েরও রয়েছে। ব্রিটিশ সাইবার বিশেষজ্ঞরা হুয়াওয়ের সফটওয়্যারে ঝুঁকি রয়েছে দাবি করলেও শেষপর্যন্ত তাদের আশ্বস্ত করতে পারেনি চীনা প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া, অস্বচ্ছ প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং মালিকানাও সংস্কার করেনি হুয়াওয়ে। ফলে আরও কয়েক ডজন দেশে নিষিদ্ধ হতে পারে হুয়াওয়ের পণ্য, এক্ষেত্রে জার্মানি ইতোমধ্যেই চূড়ান্ত অবস্থানে রয়েছে।

এরপরও উদীয়মান বিশ্বের বেশিরভাগ জায়গাতেই হুয়াওয়ের পণ্য ব্যবহৃত হবে এবং প্রযুক্তি শিল্পের বিভাজন বাড়তেই থাকবে। বাণিজ্য সাধারণত নিয়মের ওপর নির্ভর করলেও যুক্তরাজ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে অসংখ্য তদবির ও হুমকির কারণে। সমস্যা যদি চীনের তৈরি পণ্যে হয় তবে এরিকসন এবং নোকিয়াও সেই একই কাজ করে। তারা যদি চীনা প্রতিষ্ঠানের তৈরি যন্ত্রাংশ ডিভাইসগুলোতে (৫জি, রোবট বা মেশিন) সংযুক্ত করে, তবে ডিজিটালাইজড বিশ্বে একই যুক্তি প্রয়োগ করা যেতে পারে। চীনে বিক্রি হওয়া জার্মান গাড়ি বা অ্যাপলের ফোনেও একগাদা সফটওয়্যার, ডেটা ও সেন্সর থাকে। তাহলে চীনও কি সেগুলো নিষিদ্ধ করবে?

jagonews24

ভারতে চীনা অ্যাপ টিকটক নিষিদ্ধের পর একই পথে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। তাইওয়ানের কাছে অস্ত্র বিক্রির দায়ে মার্কিন প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে চায় চীন। এভাবে দুই দেশের দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে বিপাকে রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি হংকংয়ের বিশেষ সুবিধা বাতিল করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এখন চীন-যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষ থেকেই হুমকির মুখে রয়েছে হংকংয়ে বিপুল ব্যবসা করা এইচএসবিসি ব্যাংক।

সংকটের সমাধান কী?
গত কয়েক বছরে এশিয়ার প্রভাবশালী অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছে চীন। বিশ্ব রপ্তানির ১৩ শতাংশ আসে চীন থেকে, এছাড়া বিশ্ববাজারের ১৮ শতাংশ মূলধনও তাদের হাতে। ফলে চীনের বাণিজ্য বন্ধ যথেষ্ট কঠিন। ট্রাম্প প্রশাসন শুল্কবৃদ্ধি ও বিভিন্ন হুমকির মাধ্যমে চীনাদের দমানোর চেষ্টা করলেও শেষপর্যন্ত তা অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এমন পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষের লক্ষ্য হওয়া উচিত কৌশলগত সুরক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাণিজ্য বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করা। প্রযুক্তির মতো ক্ষেত্র, যেগুলো থেকে বাণিজ্য হয় কম কিন্তু উত্তেজনা তৈরি করে বেশি, সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা। এসব খাতের জন্য সূক্ষ্ম তদন্ত এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সনদের প্রয়োজন হবে, যেমনটা যু্ক্তরাজ্য হুয়াওয়ের সঙ্গে চেষ্টা চালিয়েছে। এটি পুরোপুরি কাজ না-ও করতে পারে। তবে এতে অন্তত অন্যান্য খাতের বাণিজ্য সমৃদ্ধ হবে।

চীনা সংস্থাগুলোকেও পশ্চিমা দেশে তাদের সহায়ক প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় শেয়ারহোল্ডার, বিদেশি পরিচালক, প্রকৃত স্বায়ত্তশাসনের পরিচালক প্রভৃতির বিষয়ে আরও খোলামেলা হওয়া উচিত। এ কাজটি খুব কঠিন নয়; ইউনিলিভারের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বহু বছর ধরেই এটি করে আসছে। এক্ষেত্রে টিকটক হতে পারে চীনের পক্ষে এমন পদক্ষেপের অগ্রদূত।

(ইকোনমিস্ট থেকে অনূদিত)
কেএএ/

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।