পারাপারের গল্প


প্রকাশিত: ০২:৩২ এএম, ২৬ অক্টোবর ২০১৫

বাজরাঙ্গি ভাইজান শেষপর্যন্ত সাধারণ মানুষের জয়ের গল্প। বলছি, সালমান-কারিনা জুটির সাম্প্রতিক হিন্দি ছবির কথা। গত ঈদে মুক্তি পায় সিনেমাটি। ব্যবসা করেছে দারুণ। সাড়ে তিন কোটির বেশি দর্শক ছবিটি দেখেছে। বলা ভালো হলে গিয়ে দেখেছে। মুভির কাহিনি একটু অন্যরকম। দিল্লিতে হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মাজার জিয়ারত করতে গিয়ে হারিয়ে যায় পাকিস্তানি একটি শিশু। ঘটনাক্রমে মুসলিম শিশুর স্থান হয় হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে। সে পরিবারের যুবক সালমান খান প্রতিজ্ঞা করেন শিশুটিকে তার বাবা মায়ের কাছে পৌঁছে দেবেন। সে অনুযায়ী পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই চলে যান পাকিস্তান। শুরু হয় টান টান উত্তেজনা। যদিও সিনেমাটি কমেডি-ড্রামা।

সালমান খানকে ধাওয়া করে ফেরে পুলিশ। একজন হারিয়ে যাওয়া শিশুকে বাবা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে এতো বড় ঝুঁকি নিয়েছে জেনে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ। যদিও রাষ্ট্র সালমান খানকে টিকটিকি ভেবে পেছনে লেগে থাকে। নির্যাতন করে, ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু জয় হয় মানুষের ভালোবাসার। সালমান খান বিজয় উল্লাসের মধ্য দিয়ে ফিরে আসে। অথচ, দেশ দুটি একে অন্যের প্রতি বিরূপভাবাপন্ন।

সিনেমার গল্প বাদ দিলেও পাসপোর্ট ভিসা ছাড়া সীমান্ত পার হওয়ার অনেক গল্প ছড়িয়ে আছে নানা দেশে। সাধারণত পেটের টানে সীমান্ত পাড়ি দেয় মানুষ। তাদের গল্প করুণ। জীবন অনেক কঠিন। কেউ জীবন বাঁচাতে একেবারেই ছেড়ে যায় দেশ। যুদ্ধ পেছনে ফেলে অনেকে শরণার্থী হয়, পেছনে ফেলে যায় স্বপ্ন ও স্বদেশ। আবার কেউ বা অপরাধ করে পালিয়ে বাঁচতে চায়। এমন আলোচিত একজনের নাম নূর হোসেন। নারায়ণগঞ্জ সাত খুন মামলায় তিনি প্রধান অভিযুক্ত। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতের কারাগারে আটক।  

সেদেশে অবৈধ প্রবেশের দায়ে তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। যদিও সম্প্রতি বারাসাতের একটি আদালত তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। তবে তাকে ফিরিয়ে আনতে কিছুটা সময় লাগবে। কারণ কাগজপত্র তৈরি করা। তাকে ফিরিয়ে আনা হবে ২০১৩ সালের বন্দি প্রত্যর্পণ আইনের আওতায়। আইনটি বন্দি বিনিময় চুক্তি নামেই বেশি পরিচিত। নূর হোসেনকে ফিরে পেতে বাংলাদেশ সরকার আগেই অনুরোধ জানিয়েছে। ভারতের উচ্চ আদালত ভিন্ন কোনো নির্দেশ না দিলে তাকে ফিরিয়ে আনতে কোনো বাধা রইলো না। এ থেকে বার্তা পরিষ্কার। কাজ করতে শুরু করেছে বন্দি বিনিময় চুক্তি। আরেকটি বার্তাও পাওয়া যায়, তাহলো, অপরাধ করে ভারতে পালিয়ে গেলেই পার পাওয়া যাবে না। তবে সেখানে গিয়ে লুকিয়ে থাকলে ভিন্ন কথা। লুকিয়ে থাকাও খুব একটা সহজ নয়। তার জন্য দরকার হবে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। একজন সন্ত্রাসীকে জেনেশুনে সে দেশের মানুষ ভালোবেসে লুকিয়ে রাখবে এমন আশা না করাই ভালো।

এবার কামরুলের কথা বলি। তিনি থাকতেন সৌদি আরবে। দেশে এলেন বেড়াতে। চুরির অভিযোগ এনে ১৩ বছরের এক প্রতিবন্ধি ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলার মূল হোতাদের একজন তিনি। প্রভাব ও সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে ফিরে গেলেন সৌদী আরব। তার আগে ফেসবুকে ছড়িয়ে পরে তার কর্মের ভিডিও। ভেবেছিলেন পার পেয়ে গেলেন। তা হলো না। ভিডিও পৌঁছে যায় সৌদী আরবেও। ক্ষুব্ধ হলেন প্রবাসিরা। ধরা হলো তাকে। রাখা হলো সৌদী পুলিশের হেফাজতে। সৌদী আরবের সঙ্গে বন্দি বিনিময় চুক্তি নেই। তারপরো তাকে ফিরিয়ে আনতে পারলো সরকার। সহায়তা নেয়া হলো ইন্টারপোলের। ফিরিয়ে আনা হলো পুশ ব্যাক পদ্ধতিতে। সত্যিই অনেক ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী।

এই ঘটনা থেকে পাওয়া বার্তাও পরিষ্কার। জনমত তৈরি হলে পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে গিয়েও পার পাবে না অপরাধীরা। এসব ঘটনা সরকারের কূটনৈতিক দক্ষতার প্রমাণ দেয়, মোটা দাগে এ কথা বলাই যায়। তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। বঙ্গবন্ধুর কয়েকজন খুনিকে এখনো ফিরিয়ে আনতে না পারা তেমনি একটি উদাহরণ।

বাজরাঙ্গি ভাইজান এবং নূর হোসেন এক কথা নয়। একজনের উদ্দেশ্য সরল, বড় ভালো। অন্যজনের আইনের হাত থেকে বাঁচা। একজনের জন্য নাগরিকদের অফুরন্ত ভালোবাসা অন্যজনের জন্য আইনের প্রতীক্ষা। বাজরাঙ্গি ভাইজান এবং কামরুলও এক কথা নয়। একজন একটি অপরিচিত অন্য ধর্মের শিশুর জন্য ঝুঁকি নেয়ার সাহস রাখে, অন্যজন শিশুকে পিটিয়ে মেরে ফেলার মতো দুঃসাহস রাখে। উদাহরণগুলো কাছাকাছি নয়, তারপরো মুভিটি দেখার পর, এসব ঘটনা মনে পড়ে। বিশেষ করে সীমান্ত পারাপারে মানুষের অবস্থান কতটুকু বদলে যায়, সে ভাবনা মাথায় আসে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের পর সীমান্ত ও সার্বভৌমত্ব ধারণাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হই। দেশ আলাদা একই মুদ্রা। দেশ আলাদা অথচ স্বার্থ একই। পারস্পরিক এই সহায়তা রাষ্ট্রীয়। যদি রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকরাও ভালোবাসা দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে গেঁথে যেতে পারতো বিনা সূতার মালায়, তাহলে পৃথিবী হয়তো অন্যরকম হতো। সীমান্তে হয়তো মরতো না কেউ। শরণার্থীর ঢেউ হয়তো আছড়ে পড়তো না বিভিন্ন সীমান্তে। আয়লানরা হয়তো মরতো না বেঘোরে।  বাজরাঙ্গি  ভাইজানদের সংখ্যা হয়তো বাড়তো। পরোপকারী অথচ প্রচলিত বিবেচনায় একটু বোকাদের মিছিল হয়তো আমাদের নিরাপত্তাবোধকে আরো শানিত করতো।

লেখক: সিনিয়র নিউজ এডিটর, দীপ্ত টিভি

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।