২৮ বছর পর মায়ের বুকে ফজলু মিয়া
অবশেষে দীর্ঘ ২৮ বছর পর মায়ের দেখা পেলেন ফজলু মিয়া। ২২ বছর যাকে কোনো মামলা ছাড়াই বিনাদোষে শুধু অভিভাবক না পাওয়ায় সিলেটের কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। শনিবার সন্ধ্যায় দেখা হয় মমতাময়ী মায়ের সঙ্গে ছেলের।
ছেলেকে পেয়ে মা মরিয়ম বেওয়া পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে নেন। এ সময় এক আবেগময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মা-ছেলে উভয়ের চোখ ভিজে যায় জলে।
৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে দীর্ঘ ২২ বছর কারাগারে রাখা হয়েছিল ফজলু মিয়াকে। গত ১৫ অক্টোবর তিনি জামিনে মুক্তি পান। কারগারে যাওয়ার ছয় বছর আগে ফজলু মিয়ার বয়স যখন ১০ থেকে ১২ তখন জামালপুরের বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিলেন তিনি। এরপর মায়ের সঙ্গে আর দেখা হয়নি ফজলু মিয়ার।
২৮ বছর পর গণমাধ্যমে ছবি দেখে ফজলু মিয়াকে সনাক্ত করেন তার স্বজনরা। পরে ছেলের সন্ধান পেয়ে শনিবার জামালপুর থেকে সিলেট আসেন ফজলু মিয়ার মা মরিয়ম বেওয়া ও ফজুলর বোন। সঙ্গে জামালপুরের এনডিসি জোর্তিময় পাল। জামালপুরের জেলা প্রশাসক মো. শাহাবুদ্দিন খান উদ্যোগী হয়ে সিলেট পাঠিয়েছেন তাদের।
শনিবার সন্ধ্যায় দক্ষিণ সুরমা উপজেলার তেলিবাজারে তেতলী ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে দেখা হয় মা-ছেলের। কারামুক্তির পর থেকে সেখানেই বসবাস করছেন ফজলু মিয়া। দেখা হওয়ার পর মা-ছেলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠেন। ফজলু মিয়ার মা বাক-প্রতিবন্ধী। চোখেও দেখেন না। ফজলুও অসুস্থ। তেমন কথা বলতে পারেন না। মানসিকভাবেও অপ্রকৃতস্থ।
তবু দীর্ঘদিন পর মায়ের দেখা পেয়ে উচ্ছাস তার চোখে মুখে। মায়ের দেখা পেয়ে খুশি খুশি কেবল এই একটি শব্দই দুইবার উচ্চারণ করলেন ফজলু।
জামালপুরের এনডিসি জোর্তিময় বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ফজলু মিয়াকে আমরা তার বাড়ি জামালপুরে নিয়ে যেতে এসেছি। তাকে আইনী ও চিকিৎসা সহায়তাও প্রদান করা হবে। এর আগে গত শুক্রবারই ফজলু মিয়াকে দেখতে এসেছিলেন তার মামা মফিজ উদ্দিন।
জানা যায়, ১০ থেকে ১২ বছর বয়সে ফজলু বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকায় আসেন। সেখানেই তার সঙ্গে দেখা হয় সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার ধরাধরপুর গ্রামের সৈয়দ গোলাম মাওলার। তিনি ফজলুকে তার বাড়ি নিয়ে যান।
ফজলু মিয়ার মামা মফিজ উদ্দিন জানান, প্রায় ২৮ বছর আগে ফজলু মিয়া বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন। তারপর দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। ২০-২১ বছর তার বড় ভাই (ফজলুর বড় মামা) আবদুস সাত্তার ফজলুর খবর নিতে সিলেট আসেন।
তিনি সিলেটের দক্ষিণ সুরমার ধরাধরপুর গ্রামের গোলাম মওলার বাড়ি যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন গোলাম মওলা ও তার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ফজলু উন্মাদ হয়ে বাড়ি থেকে চলে গেছেন। ফজলুর স্ত্রীরও সেখানে নেই। গোলাম মওলার বাড়ির কেউ ফজলু মিয়ার কোনো খবর জানেন না। এরপর থেকে তাদের ধারণা ছিল, ফজলু মিয়া হয়তো আর বেঁচে নেই।
মফিজ উদ্দিন বলেন, কিছুদিন আগে টেলিভিশনে ফজলু মিয়াকে দেখে তার ভাতিজা রাজু মিয়া ফোন করে জানান, ফজলু বেঁচে আছেন। এরপর বিভিন্ন পত্রিকায় ফজলু মিয়ার সচিত্র প্রতিবেদন দেখে তারা নিশ্চিত হন, এই ফজলুই তাদের হারিয়ে যাওয়া ফজলু মিয়া। এরপর তারা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
জামালপুর জেলা প্রশাসক মো. শাহাবুদ্দিন খান বিষয়টি জানতে পেরে ফজলুর প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত করতে পরিবারের সদস্যদের ডাকেন। সিলেটে অবস্থানরত ফজলুর সঙ্গে তার মুঠোফোনে কথাও বলিয়ে দেন। এরপর জেলা প্রশাসক আজ ফজলুর মাকে সিলেট পাঠান।
ফজলু মিয়ার জামিনদার সাবেক ইউপি সদস্য ও ছোটবেলার বন্ধু কামাল উদ্দিন রাসেল জাগো নিউজকে বলেন, ফজলু মিয়ার মাসহ প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা এসেছেন। তারা ফজলু মিয়াকে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু রোববার ফজলু মিয়ার মামলার হাজিরার তারিখ। আমরা তার মামলাটি খারিজের আবেদন করেছি। সেটি খারিজ হলে তার মা তাকে নিয়ে যেতে পারবেন।
জানা যায়, ফজলু মিয়া এক সময় গলায় ডালা বেঁধে সিলেট নগরে পান-সিগারেট বিক্রি শুরু করেন। সিলেট শহরের বন্দরবাজার আদালত পাড়ায় তিনি ফেরি করে পান-সিগারেট বিক্রি করতেন। ১৯৯৩ সালের ১১ জুলাই তিনি আদালত পাড়ায় পান-সিগারেট বিক্রি করছিলেন।
জাকির হোসেন নামের এক ট্রাফিক সার্জেন্ট সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করার জন্য তাকে গ্রেফতার করেন। ৫৪ ধারায় কোতোয়ালি থানায় ফজলু মিয়ার বিরুদ্ধে ডায়েরি করেন সার্জেন্ট জাকির।
এরপর পুলিশ প্রতিবেদন দিয়ে ফজলু মিয়ার বিরুদ্ধে পাগল আইনের ১৩ ধারায় অভিযোগ আনে। তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কারাগারে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ গঠন করা হয়নি। প্রায় ২২ বছর পর গত ১৪ অক্টোবর তিনি মহানগর হাকিম আদালত থেকে জামিন পান। এরপর দিন ১৫ অক্টোবর কারাগার থেকে মুক্তি পান ফজলু।
ছামির মাহমুদ/এআরএ/পিআর