গামছা তৈরি করে অভাবকে বিদায় করেছেন সাবানা
সকাল হলেই শুরু হয় ঠক ঠক শব্দ। চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সাংসারিক কাজ শেষ করে নিপুণ হাতে গামছা তৈরি করেন সাবানা বেগম। গামছা তৈরি করে সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন তিনি। নওগাঁ সদর উপজেলার শৈলগাছী ইউনিয়নের পার-বাঁকাপুর গ্রামে রাস্তার ধারে সরকারি খাস জমিতে টিনের একটি ঘরে স্বামী ও দুই মেয়েকে নিয়ে বসবাস করেন।
লেখা পড়া তেমন একটা করা হয়নি সাবানার। কিছু বুঝে উঠার আগেই বাবা-মা ১৬ বছর বয়সে বিয়ে দেন। স্বামীর সংসারে অভাব লেগেই থাকতো। অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। স্বামী যা আয় করতো তা দিয়ে সংসার চলতো না। তিনবেলা ঠিকমত খেতেও পারতেন না। স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করে গামছা তৈরির কাজ শিখবেন বলে জানান সাবানা। পরিবারের কেউই গামছা তৈরির কাজে শেখার জন্য সম্মতি দেননি।
বিয়ের এক বছরের মাথায় স্বামীকে নিয়ে আলাদা হয়ে যান সাবানা। পরে স্বামী মত দেয় কাজ শেখার জন্য। দুই মেয়ে, বড় মেয়ে তাসলিমা মাদ্রাসাতে পড়ে। ছোট মেয়ে এখনো স্কুলে যায় না। স্বামী মোজাফ্ফর হোসেন মাটি কাটা, ভ্যান চালানো ও বাড়ি ছাওয়ার (বাড়িতে টিন লাগানো) কাজ করেন।
জেলার রাণীনগর উপজেলার মিরাট গ্রামে পরিচিত আত্মীয়ের বাড়িতে প্রায় দেড় বছর ধরে গামছা তৈরির কাজ শেখেন। এরপর প্রতিবেশীর কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধার করে গামছা তৈরির একটি মেশিন ক্রয় করেন। শুরু করেন গামছা তৈরির কাজ। ১১ বছর থেকে গামছা তৈরি করে আসছেন তিনি। স্বামী মোজাফফর হোসেনও এ কাজে তাকে সহযোগিতা করেন।
বাজার থেকে সুতা কিনে এনে অ্যারাউট দিয়ে ভিজিয়ে রেখে গরম পানিতে সিদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে বাঁশের চরকিতে উঠানো হয়। এরপর একটি ড্রামে ভালো করে জড়িয়ে রাখা হয় সুতা। সেখান থেকে ইমার বা লরদে (যেখানে সুতা জড়িয়ে রাখা হয়) এবং ব-তে সুতা সাইজ করে জড়িয়ে কাঠের মেশিনে স্থাপন করা হয়। তিন দিনের মতো সময় লাগে কাঁচামালকে শোধন করে মেশিনে স্থাপন করতে। এরপর গামছা বুননের কাজ করা হয়। সাত দিনের মতো সময় লাগে সুতাগুলো দিয়ে গামছা তৈর করতে।
কাঠের মেশিনের খরচ পাঁচ হাজার টাকা। ব-সাড়ে ৩শ টাকা, মাকু ১৩৫ টাকা (প্রায় এগুলো নষ্ট হয়)। বগুড়ার সান্তাহার থেকে এ সুতাগুলো কিনে আনা হয়। সুতা কিনতে ২ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। আগে ছিল ৪২ টাকা মোড়া (৫টা ১ মোড়া)। ২ মাস থেকে দাম বেড়ে যাওয়া এখন ৪৫ টাকা মোড়া হয়েছে। বেড়ে যাওয়ার কারণে এখন একটু লাভ কম হয়।
ইমারে একবার জড়ানো সুতায় সাড়ে তিন বাই দেড় হাত সাইজের ৬০টি গামছা তৈরি হয়। ২টি মোড়ার সুতায় চারটি গামছা তৈরি হয়। চারটি গামছায় প্রায় ৯০ টাকার মতো খরচ হয়। দিনে আটটি থেকে ১২টি গামছা তৈরি করা হয়। বাজার অনুসারে বিক্রি হয় ২৩৫/২৪০ টাকায়। বাজার অনুসারে গামছার দাম কম বেশি হয়। তবে কাঁচামাল সুতার দামের কারণে গামছার দাম একটু বেড়েছে। নওগাঁ শহরের দোকানে পাইকারি এবং নওগাঁ সদরের শৈলগাছী ত্রিমোহনী হাটে ও বগুড়ার সান্তাহার হাটে খুচরা বিক্রি করা হয়।
সাবানা জানান, আগে অনেক অভাবে ছিলাম। অবস্থাও খারাপ ছিল। গামছা তৈরির কাজ করার পর থেকে সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে আসে। প্রতিবেশীরা অনেক সহযোগিতা করেছে। ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে একটি টিনের ঘর করেছি। এ কাজ করতে অনেক সময় পুঁজি থাকে না।
সাবানা আরো জানান, কাজ করার সময় মনোযোগ সরে গেলে সুতা নষ্ট হয়। নষ্ট সুতা আর কাজে লাগে না। একবার দুই হাজার টাকার সব সুতাই নষ্ট হয়ে যায়। সরকারি সহযোগিতা ও কোনো সংস্থা থেকে স্বল্প সুদে ঋণ পেলে ব্যবসার কাজে সুবিধা হতো।
স্বামী মোজাফ্ফর হোসেন জাগো নিউজকে জানান, মাটি কাটা, ভ্যান চালানো ও বাড়ি ছাওয়া (বাড়িতে টিন লাগানো) কাজ করি। পাশাপাশি স্ত্রীকেও গামছা বুনানোর কাজে সহযোগিতা করি। আগের থেকে এখন সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে আমাদের।
আব্বাস আলী/এমজেড/পিআর