নতুন কইরা দ্যাশ স্বাধীনের স্বাদ পাইছি : বীরাঙ্গনা মনছুরা
দ্যাশ স্বাধীন হইছে অনেক দিন হইলো। জানোয়ারদের নির্যাতনের ক্ষত শরীর থাইক্যা মুইছা গ্যালেও মনের ভিতরকার ক্ষত রইয়াই গ্যাছে। অহনো মাইঝ রাইতে জাইগা উঠি, ঘুম আহে না। এতদিন পরে অইলেও সরকার আমাগো দিকে তাকাইছে। হেইডাতো অনেক পাওয়া। মনে হয় নতুন কইরা দ্যাশ স্বাধীনের স্বাদ পাইছি।
কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ওঠেন পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মম নির্যাতনের শিকার রংপুর নগরীর ৯ নং ওয়ার্ডের বাহার কাছনা তকেয়ার পাড় এলাকার বীরাঙ্গনা মনছুরা বেগম।
ষাট ঊর্ধ্ব বয়সী মনছুরা চশমার ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়া দু’চোখের পানি মুছতে মুছতে সেই ভয়াল স্মৃতি আর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া অনুভূতির কথা তুলে ধরেন জাগো নিউজের কাছে।
সময়টা ১৯৭১। মনছুরার বয়স তখন ১৮ কি ১৯। বাংলা বৈশাখ মাসের শেষের দিক। চারিদিকে আতঙ্ক, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। তরতাজা যুবকদের ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে-এমন খবর শুনে সদ্য বিবাহিত স্বামী গোলাম মোস্তফা সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধে যাবেন। বাড়িতে থাকলেও মৃত্যু অনিবার্য তাই যুদ্ধে যাওয়াই ভালো মনে করেন তিনি।
এদিকে স্বামীর যুদ্ধে যাবার কথা শুনে মনছুরার মন আঁতকে ওঠে। বাধা দিলেও সেটাতে কাজ হয় না। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে স্বামী চলে গেলেন ভারতে। বাড়িতে শুধু বৃদ্ধ শ্বশুর আর মনছুরা। কাল বৈশাখী ঝড় যেন তখনই নেমে আসে তার জীবনে।
সারাদেশের মানুষের মতোই শ্বশুর আর অনাগত (তিন মাসের গর্ভ) সন্তানকে নিয়ে শঙ্কায় দিন কাটতে থাকে। পৃথিবীতে তার প্রথম সন্তান আসছে। এই ভেবে একজন মায়ের যতোটা উচ্ছ্বাসিত হবার কথা তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি উদ্বিগ্ন মনছুরা। না জানি কি হয়! শেষ পর্যন্ত অনাগত সন্তানটিকে কি পৃথিবীতে আনতে পারবেন?
অবশেষে তার শঙ্কাটাই সত্যি হয়ে ওঠে। ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়ের সেদিন সকালটা ছিল তার জন্য ভয়ানক একটা সকাল। অন্যান্য দিনের মতোই ঘুম থেকে উঠে ঘরের ভিতর কাজে ব্যস্ত ছিলেন মনছুরা। হঠাৎ বাইরে গুলির শব্দ শুনে আঁতকে ওঠেন তিনি। কিছু বুঝে উঠার আগেই দানবের মতো ১০/১২ জন লোক বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ায়। ছেলের যুদ্ধে যাবার অপরাধে পেটাতে থাকে বৃদ্ধ শ্বশুরকে। রাইফেলের বাট আর বুটের আঘাতে নিস্তেজ হয়ে পড়েন শ্বশুর। এ দৃশ্য দেখে ঘর থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেন পাশের এক বাড়িতে। কিন্তু তাতেও রেহাই মেলেনি। তিনজন পাক হানাদারের সাথে তারই প্রতিবেশি আরও একজন। পিছনে পিছনে এসে ঘরের ভিতর ঢুকে শুরু করে পাশবিক নির্যাতন।
মনছুরা বলেন, বাপ কইয়া ডাইকা পায়ে পড়ছি তবুও হ্যারা আমারে ছাড়লো না। জোর কইরা টাইনা-হ্যাচরাইয়া গাড়িতে আমারে আর শ্বশুরকে তুইলা নিয়া যায় টাউন হলে (তৎকালীন টর্চার সেল)। কয়েকদিন পর শ্বশুরকে ছাড়লেও আমারে আটকাইয়া রাখে।
এখানেই শেষ নয়, হায়েনাদের পাশাবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে প্রায় রাতেই জ্ঞান হারাতো মনছুরা। মনে হত আজই বুঝি তার জীবনের শেষ রাত। ভোর হয়, দিনের আলোর সাথে সাথে আবার প্রাণ ফিরে পায় মনছুরা।
এদিকে, একটু একটু করে শেষ হয়ে যেতে থাকে অনাগত সন্তানকে নিয়ে দেখা সকল স্বপ্ন। তিনি বুঝতে পেরে গেলেন তার বুকের মানিকের আর আসা হবে না এই পৃথিবীতে, আর কোনোদিন মা ডাক শুনবেন না ওর মুখ থেকে এবং তাই হলো। মারা গেল মনছুরার গর্ভের নিষ্পাপ শিশুটি। এভাবেই কেটে যায় রংপুর টাউন হলে ১৯ দিন।
মনছুরা বলেন, ছাইড়া দ্যাওনের লাগি জানোয়ার গোরে কত কইছি। হ্যাগোর (তাদের) মন গলেনি। বেশি কইলে পিডের (পিঠ) মধ্যে গরম ছ্যাঁকা দিত। মুখ বুইজা সব সহ্য করছি।
তার কাছ থেকে জানা যায়- তাকে যে রুমে আটক রাখা হয়েছিল, ওই রুমে আরও ১০/১২ জন যুবতী মেয়ে এবং পাশের রুমেও ১০/১২ জন যুবতী মেয়ে আটক ছিল। তাদের কারও পড়নে সালোয়ার-কামিজ, কারও পরনে শাড়ি ছিল। তাদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের কথা বলতে দেয়া হতো না। তাদের সেখানে আলবদর ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পাহারা দিয়ে রাখতো। রাতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে গাড়িতে আর্মি অফিসাররা টাউন হলে আসত এবং মনছুরা ও আটককৃত যুবতী মেয়েদেরকে বিভিন্নস্থানে নিয়ে গিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করত। মনছুরা যে টাউন হলে আটক ছিলেন সেই হলের অনেক সময়েই জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও আলবদররা প্রতিরাতেই অনেক পুরুষ এবং মহিলাকে উলঙ্গ করে ঝুলিয়ে চাকু দিয়ে শরীর ক্ষতবিক্ষত করত আর কাপড় পেঁচানো লাঠি অ্যাসিডের মাঝে ভিজিয়ে কাটা জায়গায়, নাকে, মুখে, চোখে, যৌনাঙ্গে দিত এবং মরে গেলে লাশ উত্তর পাশের কূপ এবং ঝোপ জঙ্গলে ফেলে দিত।
১৯ দিন পর টাউন হল থেকে ছেড়ে দেয়া হয় মনছুরাকে। কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে চলে আসেন বাড়ির পাশে এক নিকটাত্মীয়ের কাছে। সেখানেই গোপনে চিকিৎসা চলে তার। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন মনছুরা।
এদিকে, দেশ স্বাধীন হয়। সব কিছুই যখন স্বাভাবিক হয়ে উঠতে শুরু করে ঠিক তখনও অনিশ্চয়তায় কাটতে থাকে তার প্রতিটি মুহূর্ত। স্বামী ফিরে এসে সব শুনে বেঁকে বসেন। অবশেষে এলাকার মুরব্বী আর স্বজনদের কথায় মেনে নেন মনছুরাকে। স্বাধীনতার যুদ্ধের পর শুরু হয় মনছুরার জীবন যুদ্ধ।
বীরাঙ্গনা মাতা মনছুরার কোল জুড়ে আসে চার মেয়ে আর দুই ছেলে। সবার বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে দীন মোহাম্মদ আলী মাস্টার রোলে কাজ করেন রংপুর সেনানিবাসে। আর ছোট ছেলে মনছুর আলী বাবার পেশা রিকশাকেই বেছে নিয়েছেন।
বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েছেন গোলাম মোস্তফা। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ঠিক মতো হাটতে পারেন না। তাই বাড়িতে বসেই অধিকাংশ সময় কাটে তার।
গোলাম মোস্তফা জাগো নিউজকে জানান, স্ত্রী হিসেবে মনছুরাকে পেয়ে ভিষন সুখী তিনি। ওই নরকীয় অধ্যায় ভুলে গিয়ে মনছুরাকে কাছে টেনে নিয়েছেন। চেষ্টা করেছেন একজন ভালো স্বামী হয়ে সবসময় তার পাশে থাকার।
স্বামীর প্রতিও কোনো অভিযোগ নেই মনছুরার।
তিনি বলেন, মানুষডা বড়ই বালা (ভাল)। হ্যায় যদি আমারে ঘরে না তুলতো তা অইলে মরণ ছাড়া আর কুনু রাস্তাই (উপায়) আছিল না।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া মনছুরার আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। বর্তমান সরকারের এমন উদ্যোগে আবেগ আপ্লুত হয়ে জাগো নিউজকে জানান তার শেষ ইচ্ছের কথা। বড় ছেলের চাকরিটা সরকারিকরণ আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দু’চোখ দিয়ে দেখতে চান তিনি। বেঁচে থাকতে তার এ স্বপ্ন পূরণ হবে-এমনটাই আশা করছেন বীরাঙ্গনা মনছুরা বেগম।
এমএএস/আরআইপি