অনেক আতঙ্কের মাঝেও আশা দেখাচ্ছে করোনা
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারির ভয়াবহতা নিয়ে মানুষ এখন দিন কাটাচ্ছে আতঙ্কে। সংক্রমণ বাড়ছে, মৃত্যুর হারও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বিভিন্ন দেশে ছোটবড় অনেক শহর অবরুদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে। বহু মানুষকে জনবিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে।
কিন্তু এই উদ্বেগপূর্ণ সময়ের মধ্যে মানুষ আশার আলোও দেখার চেষ্টা করছেন নানা খবরের মধ্যে। সবকিছু একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কিছু ইতিবাচক ঘটনাও ঘটছে। যেমনর:
বিশ্বজুড়ে কমছে দূষণ
করোনাভাইরাসের কারণে বিভিন্ন দেশে লকডাউন অবস্থা জারি করার ফলে দূষণের মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। চীন এবং উত্তর ইতালিতে গাড়ি চলাচল ও কলকারখানার কাজ কমে যাওয়ায় বাতাসে নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং শক্তিশালী রাসায়নিক উপাদান যা উষ্ণায়ন ঘটায় তার মাত্রা ব্যাপক হারে কমে গেছে।
নিউ ইয়র্কের গবেষকরা বলেছেন প্রাথমিক গবেষণার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে মূলত গাড়ি থেকে নির্গত কার্বন মনোক্সাইডের মাত্রা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
এছাড়াও বিভিন্ন দেশে বিমান সংস্থাগুলো গণহারে বিমান চলাচল বাতিল করে দেয়ায় এবং লাখ লাখ মানুষ ঘর থেকে কাজ করার কারণে বিশ্বজুড়ে দূষণের মাত্রা কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
একইভাবে, ইতালির ভেনিস শহরের বাসিন্দারা বলছেন, ওই শহরের মধ্য দিয়ে যে বিখ্যাত লেক বয়ে গেছে, তার শাখাপ্রশাখার ওপর পুরো ভেনিস শহর দাঁড়িয়ে আছে। লেকের পানির মান আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিষ্কার হয়ে গেছে।
উত্তর ইতালি যেসব স্থানে জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ অবস্থিত, সেগুলো এখন করোনা উৎকণ্ঠার কারণে জনশূণ্য। ভেনিসে যেহেতু লেকই যাতায়াতের পথ তাই লেকের ব্যবহার উল্লেখেযোগ্য হারে কমে গেছে। ফলে পানির ভাসমান কণাগুলো নিচে থিতিয়ে পড়ে পানি পরিষ্কার হয়ে গেছে।
সাধারণত লেকের পানি সেখানে খুবই ঘোলা থাকে। এখন পানি এতই পরিষ্কার ও স্বচ্ছ হয়েছে যে সেখানে মাছের আনাগোনা চোখে দেখা যাচ্ছে।
মানুষ সহাযোগিতার হাত বাড়াচ্ছে
করোনাভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে পাগলের মত বাজার করে মানুষের জিনিস মজুত করার, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য মারামারি করার নানা ঘটনা খবর হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এর উল্টো দিকে, এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর পৃথিবীর অনেক দেশে অনেক মানুষের মধ্যে পরোপকারের যে মানসিকতা তৈরি হয়েছে, তারা দয়ার হাত বাড়িয়ে দিতেও যে শিখেছে সেসব ঘটনাও খবরে এসেছে।
নিউ ইয়র্কে দুই ব্যক্তি ৭২ ঘন্টার মধ্যে ১৩০০ স্বেচ্ছাসেবক জোগাড় করেছেন যারা বৃদ্ধ এবং অসুস্থ মানুষদের বাড়ি বাড়ি খাবার ও ওষুধ পৌঁছে দিয়েছে।
ব্রিটেনেও বৃদ্ধ ও অসুস্থদের খাবার ও ওষুধ পৌঁছতে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছে কয়েক হাজার মানুষ। একই ধরনের দলবদ্ধ গোষ্ঠিকে দেখা গেছে কানাডায় মানুষের সাহায্যে পথে নামতে।
অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রিটেনসহ পশ্চিমের বেশ কয়েকটি দেশে বড় বড় বিপনিবিতানে বৃদ্ধ মানুষদের বাজার করার জন্য নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ করে দেওয়া হয়েছে, যখন তারা ছাড়া আর কেউ বাজার করতে পারবেন না। যাতে তারা ধাক্কাধাক্কি এড়িয়ে শান্তিতে বাজার করতে পারেন।
প্রবীণ জনগোষ্ঠির জন্য অর্থ সাহায্য করা, তাদের শরীর সুস্থ রাখার জন্য ব্যায়ামের ব্যাপারে নানা উপদেশ পরামর্শ ও সাহায্য দেয়া এবং যারা পরিবারের সবার থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অর্থাৎ আইসোলেশনে দিন কাটাচ্ছেন তাদের মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য পৃথিবীর নানা দেশে নানাধরনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। অনেক দোকানপাটে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবার পর সেগুলো খাদ্য বন্টনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
সচরাচর কর্মস্থল আর দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততা মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছিল। নিজের পরিবারের ভালমন্দের বাইরে ভাবার কারও সময় ছিল না।
এখন এই করোনাভাইরাসের ছোবল সবার ওপর এসে পড়ায় সবার মনেই কাজ করছে একই ধরনের উদ্বেগ, একই ধরনের ভয়। সারা বিশ্বের সব মানুষের সামনে এখন একটাই সমস্যা- একটাই উদ্বেগ- আমার সামনে কী? আর এই একই শত্রু সবাইকে সমান তারে বেঁধে দিয়েছে।
ইতালিতে গোটা দেশজুড়ে যখন লকডাউন চলছে, যখন শ'য়ে শ'য়ে মানুষ প্রতিদিন ভাইরাসে প্রাণ হারাচ্ছেন, যখন মানুষের আর কোথাও যাবার নেই, তখন সেখানে বাড়ির বারান্দায় বারান্দায় শোনা যাচ্ছে নিজেদের উদ্দীপ্ত করার জন্য মানুষ গান গাইছেন।
দক্ষিণ স্পেনে একজন শরীরচর্চা বিষয়ক শিক্ষক একটি অ্যাপার্টমেন্ট বাড়ির মাঝামাঝি নিচু একটি ছাদ থেকে ব্যায়াম শেখানোর ক্লাস শুরু করেছেন, যাতে ওই বহুতল ভবন কমপ্লেক্সে যারা নিজেদের আইসোলেট করে রেখেছেন, তারা তাদের ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে ওই ক্লাসে যোগ দিতে পারেন।
বহু মানুষ তাদের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বেশি বেশি কথা বলছেন- ফোন করে বা ভিডিওর মাধ্যমে তাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন আগের তুলনায় অনেক বেশি, কারণ অনেকের হাতে এখন অফুরন্ত সময়।
অনেকে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনে গড়ে তুলেছেন ক্লাবঘর, সেখানে ফোনের মাধ্যমে চলছে তাদের ভার্চুয়াল আড্ডা। করোনাভাইরাস মানুষের সঙ্গে মানুষের নতুন যোগাযোগের সূত্রই শুধু গড়ে তোলেনি, যেসব ডাক্তার, নার্স, ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ভাইরাসের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে মানুষের চিকিৎসা করে যাচ্ছেন যারা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জীবন রক্ষায় কাজ করছেন, মানুষ তাদের কাজকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে শুরু করেছে।
ইউরোপের নানা দেশের মানুষ ইতোমধ্যেই বাড়ির বারান্দায়, ঘরের জানালায় সমবেত হয়ে তাদের করতালি দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
সৃজনশীলতার নতুন জোয়ার
লাখ লাখ মানুষ গৃহবন্দী হয়ে পড়ার পর অনেকেই এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সৃজনশীল হবার চেষ্টা করছে।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ তাদের শখের খবর শেয়ার করছে। যেমন বই পড়া, কেক পাউরুটি বেক করা, উল বোনা, ছবি আঁকা। একই ধরনের শখ যাদের আছে তারা সেসব নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছেন।
অনলাইনে বই পড়ার ক্লাব খুলেছে কেউ, ইনস্টাগ্রামে রান্না শেখানোর নানা আয়োজন চোখে পড়ছে। ঘরে আটকে আছে যারা, তারা নতুন নতুন রেসিপি শেয়ার করে নিজেদের সময় কাটাচ্ছে।
আমেরিকার টেনেসিতে একজন চারুকলার শিক্ষক স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া শিশুদের জন্য ফেসবুকে লাইভ স্ট্রিমিং-এর মাধ্যমে সৃজনশীল নানা কাজ শেখানোর ক্লাস করছেন।
সিডনির তারাঘর বা অবজারভেটরিও, যারা ঘরে আইসোলেশনে আটকে আছেন, তাদের জন্য ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে অনলাইনে রাতের তারাভরা আকাশ দেখার ব্যবস্থা।
টিটিএন/জেআইএম