চীনের পাশে হলেও যেভাবে করোনার লাগাম ধরে রেখেছে তাইওয়ান-সিঙ্গাপুর
বৃহস্পতিবার, সকাল ৮টা। এর মধ্যেই কর্মস্থলের উদ্দেশে বেরিয়ে গেছেন সান্দ্রা জনসনের স্বামী। একটু পর কেনাকাটার জন্য পাশের একটি শপিংমলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন সান্দ্রা নিজেও। যেন কোনও টেনশন নেই! দিব্যি খাচ্ছেন-দাচ্ছেন, কাজ করছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পৃথিবীজুড়ে করোনাভাইরাসের তাণ্ডব চললেও এর কোনও প্রভাবই পড়েনি সান্দ্রার জীবনে!
এ ঘটনা এশিয়ারই দেশ সিঙ্গাপুরে। বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ও পরিবহনকেন্দ্র ছোট্ট এ নগররাষ্ট্রটি। সারাবিশ্ব থেকে অহরহই বিদেশিরা প্রবেশ করেন সেখানে। তারপরও প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠিকই ঠেকিয়ে রেখেছে তারা।
সান্দ্রা বলেন, ‘সিঙ্গাপুরের রাস্তায় গাড়িঘোড়া চলছে, দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট সব খোলা। আমি ইচ্ছামতো বাইরে যেতে পারছি। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এখানে।’
শুধু সিঙ্গাপুরই নয়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক তাইওয়ানেও। স্বায়ত্বশাসিত এ অঞ্চলটি চীনের মূল ভূখণ্ডের একদম কাছে। একারণে করোনা প্রাদুর্ভাব শুরুর পরপরই তাইয়ানকে ‘দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ অঞ্চল বলা হচ্ছিল। অথচ তিন মাস পর সেখানে এখনও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১৫৩, প্রাণহানি মাত্র দু’জনের।
কিন্তু কীভাবে? কীভাবে তারা আটকে দিল করোনাভাইরাসের মহামারি? কী করেছে তাদের সরকার?
এক্ষেত্রে সবার আগে যে পদক্ষেপের কথা আসে, তা হচ্ছে- জনসমাগম বন্ধ করা। স্কুল, অফিস-আদালত, দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট খোলা থাকলেও রয়েছে কিছুটা কড়াকড়ি। কোথাও বেশি ভিড় করা যাবে না।
দুই শহরের কর্তৃপক্ষই করোনা আক্রান্ত শনাক্ত করে আইসোলেশনে রাখা, তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোসহ বিদেশভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ করছে কড়াভাবে।
তাইওয়ান
তাইওয়ানের করোনা নিয়ন্ত্রণের সাফল্যের মূলে রয়েছে সার্স (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম) সংকটের অভিজ্ঞতা। ২০০২-০৩ সালের ওই মহামারির পরপরই একটি জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে তারা।
সম্প্রতি চীনের উহানে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পরপরই বিদেশফেরত নাগরিক শনাক্তকরণ শুরু করে তাইওয়ান কর্তৃপক্ষ। চীন থেকে জ্বর, সর্দি, কাশি নিয়ে কেউ ফিরলেই তাকে সোজা আইসোলেশনে পাঠানোর নির্দেশ দেয় তারা।
স্বাস্থ্য ও ভ্রমণবৃত্তান্ত একীভূত করে তারা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সম্ভাব্য রোগীদের চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। চিকিৎসক এবং ফার্মেসিগুলোকে নাগরিকদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ইতিবৃত্ত ও স্বাস্থ্যবীমার ডিজিটাল ফাইলগুলো ব্যবহারেরও ব্যবস্থা করে দেয় কর্তৃপক্ষ।
করোনা সংকট শুরুর পরপরই দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় উপকরণের মজুত বৃদ্ধি এবং ভাইরাসপ্রতিরোধী মাস্ক তৈরিতে শত শত সেনাকে কাজে লাগায় তাইওয়ান। ইতোমধ্যেই ২ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যার অঞ্চলটিতে সার্জিক্যাল মাস্ক ৪ কোটি ৪০ লাখ ও উন্নত এন৯৫ মাস্ক জমা হয়েছে প্রায় ২০ লাখ পিস।
মাস্কের দাম যেন কেউ বেশি নিতে না পারে সেটিও নিশ্চিত করেছে তাইওয়ান কর্তৃপক্ষ। সেখানকার সব নাগরিককে প্রতি সপ্তাহে জনপ্রতি দু’টি মাস্ক দেয়ারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এছাড়া, কোয়ারেন্টাইন নির্দেশনা ভঙ্গকারীদের জন্য বড় জরিমানারও ব্যবস্থা করেছে তারা। এ নির্দেশনা না মানায় সম্প্রতি হংকংয়ের তিন পর্যটককে ধরে তিন হাজার ডলার করে জরিমানা করা হয়েছে। কোয়ারেন্টাইন ভঙ্গকারী আরও তিনজনের নাম গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে, যেন সবাই তাদের থেকে সাবধানে থাকতে পারেন।
বাড়তি মাস্ক তৈরি করার কারণে টয়লেট পেপারের সংকট দেখা দিয়েছে- এমন গুজব প্রচারকারীদের ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার জরিমানার নজির সৃষ্টি করেছে তাইওয়ান কর্তৃপক্ষ।
সিঙ্গাপুর
করোনা নিয়ন্ত্রণে চমৎকার উদারণ সৃষ্টি করেছে সিঙ্গাপুরও। সার্স মহামারির অভিজ্ঞতা থেকে তারা ৩৩০ সম্পন্ন সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে।
গত ৩১ ডিসেম্বর উহানে প্রথমবার করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। আর ৩ জানুয়ারি থেকেই চীনফেরত যাত্রীদের শারীরিক পরীক্ষা শুরু করে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ। ওই মাস শেষ হতে না হতেই সারাবিশ্ব থেকে আগত যাত্রীদেরই স্বাস্থ্য পরীক্ষা শুরু করে তারা। সেসময় প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার ২০০ জনের শারীরিক পরীক্ষা করেছে সিঙ্গাপুর।
এছাড়া, করোনা আক্রান্ত বা সংক্রমণের স্থান শনাক্ত করতে দিনে অর্ধশতাধিক পুলিশ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সিঙ্গাপুরের অ্যাসিসটেন্ট পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট জনি লিম বলেন, ‘এটা অনেকটা অপকর্ম সমাধানের মতো। বিভিন্ন লোক, বিভিন্ন জায়গা থেকে টুকরো টুকরো তথ্য জড়ো করা- এই কাজে প্রায় একই ধরনের দক্ষতা দরকার।’
ইতোমধ্যেই কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তি ও তাদের নিকটতমদের শনাক্ত করতে মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং প্রযুক্তি কাজে লাগাচ্ছে দেশটির পুলিশ। হার্ভার্ড পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সংক্রমণের শুরুর দিকে সিঙ্গাপুর বাকি বিশ্বের চেয়ে গড়ে অন্তত তিনগুণ বেশি করোনা আক্রান্ত রোগী খুঁজে বের করেছে।
শনিবার করোনায় প্রথম দুই রোগীর মৃত্যুর পর স্বল্পমেয়াদি ভ্রমণার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ। দেশটিতে এ পর্যন্ত অন্তত ৪৩২ জনের শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে। এদের মধ্যে ১৪০ জন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
সূত্র: ন্যাশনাল পোস্ট
কেএএ/পিআর