প্রেম অভিসারই কাল হলো সাজ্জাদের


প্রকাশিত: ০৩:০২ পিএম, ১১ অক্টোবর ২০১৫

বাঁধাযুক্ত ছাত্রজীবনের প্রথম ধাপ পেরিয়ে মুক্ত মঞ্চে হাঁটা শুরু দুই বছর আগে। দ্বাদশ শ্রেণির মুক্ত আবহে চারপাশ দাপিয়ে বেড়ানোর সময়ে কপালে জুটেছে প্রেমের ছোঁয়াও। চতুর্থদিক সমান্তরাল এসময়ে তাই প্রেমিক জুটির অভিসারও যেন সময়ের সঙ্গে তাল মেলানো। কিন্তু এ অভিসারই কাল হলো এ প্রেমিক জুটির।

দুই যুবার উল্লাসিত সময় কাটানোতে ঈর্ষান্বিত বেরসিক বখাটেদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সইতে না পেরে অপমানে আত্মহনন করেছে কলেজ ছাত্র সাজ্জাদ। শনিবার রাতে ঘটা এ ঘটনায় পুলিশ রোববার সকালে মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠিয়েছে।
 
নিহত সাজ্জাদ হোসেন (১৮) কক্সবাজার হার্ভাড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার গ্রামের বাড়ি কুতুবদিয়া উপজেলায়।
চাচার সঙ্গে লারপড়ার ছালেহ আহমদ নামের এক ব্যক্তির বাসার ভাড়া থাকতেন তারা কয়েকজন। এ ঘটনায় সাজ্জাদের প্রেমিকা ও রুমমেট চাচাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ।
 
স্থানীয় ওয়াকিবহাল মহলের মতে, সাজ্জাদের সঙ্গে পূর্ব লারপাড়ার রিয়া নামের এক মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। মেয়েটি কক্সবাজার টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী। চাচাসহ অন্য রুমমেটের অনুপস্থিতিতে মাঝে-মাঝে প্রেমিক সাজ্জাদের সঙ্গে তার বাসায় দেখা করতো রিয়া। এটি আড়ালে আবডালে অবলোকন করতো এলাকার কিছু বখাটে। কিন্তু প্রেমিকজুটি এ বিষয়টি কোনোভাবেই জানতে পারেননি। তাই শনিবার সকাল ১০টার দিকে রিয়া সাজ্জাদের বাসায় আসে। কিন্তু প্রেমিক-প্রেমিকাকে ধরতে সেখানে আগেই ওঁৎপেতে ছিল স্থানীয় ১০/১২ জন বখাটে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সাজ্জাদ ও রিয়াকে জিম্মি করে টাকা আদায়।

রিয়া সাজ্জাদের কক্ষে প্রবেশ করা মাত্রই পরিকল্পনা মোতাবেক ওই বখাটেরা বাহির থেকে কক্ষের দরজায় তালা দিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে তারা প্রেমিকজুটিকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা না দেয়ায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দুজনকে আটকে রাখে বখাটেরা। এ ঘটনা জানাজানি হলে এলাকার লোকজন সারাদিন ভিড় জমান সেখানে। এসময় প্রেমিকজুটিকে শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম নির্যাতন করেছে বখাটেরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাজ্জাদের এক রুমমেট জাগো নিউজকে জানান, চাচা রুবায়েতসহ অন্য রুমমেটরা সকালে যার যার কাজে চলে যায়। দুপুরে বাসায় ফিরে তারা সাজ্জাদ ও তার প্রেমিকা রিয়াকে আটকে রাখার দৃশ্যটি দেখতে পান। এসময় সাজ্জাদ রুমমেটদের জানিয়েছেন, বখাটেরা ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে তাকে ব্যাপক মারধর করেছেন। তার শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতের চিহ্নও দেখেছেন রুমমেটরা।

পুলিশের হাতে আটক সাজ্জাদের চাচা কক্সবাজার কলেজের অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্র রুবায়েত জানিয়েছেন, দুপুরে বাসায় ফিরে তিনি আর বের হননি। তিনি তালাবদ্ধ সাজ্জাদ ও রিয়ার সঙ্গে রুমে ছিলেন রাত পর্যন্ত। এসময় বখাটেরা ছুরি নিয়ে চারিদিক থেকে ঘিরে রাখেন তাদের।

তিনি বলেন, রাত আটটার দিকে প্রস্রাবের কথা বলে সাজ্জাদ বাথরুমে যায়। কিন্তু বাথরুমে ঢুকে অনেক্ষণ কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। বাথরুমের দরজা ঠেলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। শেষে বখাটেরাসহ এসে ধাক্কা দিয়ে দরজা ভেঙে বাথরুমের চালার গাছের সঙ্গে গামছায় ঝুলে থাকা সাজ্জাদের মরদেহ দেখে সব বখাটে পালিয়ে যায়। এরপর হতবিহ্বল হয়ে রুবায়েত পুলিশকে খবর দেন।

কক্সবাজার সদর মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-তদন্ত) বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী জাগো নিউজকে জানান, খবর পেয়ে পুলিশ মরদেহটি উদ্ধার করে। এসময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চাচা রুবায়েত ও প্রেমিকা রিয়াকে আটক করা হয়। এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বখাটেদের মধ্যে ছিল, লারপাড়ার আবদুস শুক্কুরের ছেলে হারুন, আবুল হোসেন ড্রাইভারের ছেলে মামুন, চৌকিদার মুছা আলীর ছেলে আবদুল গণি, ধলামিয়ার ছেলে রুবেল, দিল মোহাম্মদের ছেলে ইসমাঈল, ফাতেমার ছেলে ফারুক, কবির আহমদের ছেলে ফারুক, গুল হোসেনের ছেলে দেলোয়ার। তারা সবাই এলাকার চিহ্নিত অপরাধী।

এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, তারা সবাই আবদুল গণি বাহিনী নামে এলাকায় পরিচিতি। তারা পুরো লারপাড়া দাপিয়ে বেড়ান। সাধারণ মানুষকে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়, ইয়াবা বিকিকিনি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধের সঙ্গে তারা জড়িত। তাদের গডফাদার হিসেবে রয়েছেন বাংলাবাজারের শফিউল আলম।

সাজ্জাদের মৃত্যুর পর দায়ী বখাটেদের বাঁচাতে ইতোমধ্যে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন শফিউল আলম। তিনি ঘটনার পরপরই থানায় গিয়ে তদবির শুরু করেছেন এবং সরকার দলীয় নেতাদের ব্যবহার করে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছেন এই বলে জানা গেছে।

এটিকে নিয়তি মেনে কোনো অভিযোগ না করে মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন সাজ্জাদের স্বজন। তাদের ভাষ্য, বখাটেরা শহরের বাসিন্দা। সুদূর কুতুবদিয়া থেকে এসে তাদের বিরুদ্ধে লড়া সম্ভব হবে না। তাই কোনো অভিযোগও করা হবে না।  

কক্সবাজার মডেল থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসলাম হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, রোববার সন্ধ্যায় সাজ্জাদের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আমরাও বেশ কয়েকজন দুর্বৃত্তের নাম পেয়েছি। পুলিশ ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সায়ীদ আলমগীর/এমজেড/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।