বীরের বেশে উহান ছাড়লেন ৪২ হাজার চিকিৎসক-নার্স
যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র। যেখানে লুকায়িত শত্রুর সঙ্গে অহর্নিশ লড়াই চলছে। এই লড়াই শত্রুকে ধ্বংস করার। খালি চোখে দেখতে না পাওয়া এই শত্রুকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা। ছোট্ট একটি এলাকায় এই শত্রুর আক্রমণ শুরু হলেও তা ধীরে ধীরে ছড়াতে থাকে সর্বত্র। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। যে শত্রুর নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই; তার লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছেন রাষ্ট্রের প্রধান থেকে ফুটপাতে জীবন কাটিয়ে দেয়া আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা।
নতুন এক করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এমন এক লড়াইয়ের শুরু হয়েছিল গত বছরের শেষদিনে, ৩১ ডিসেম্বর। চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে। ১০ কোটি মানুষের এই শহরের একটি বন্যপ্রাণী এবং সামুদ্রিক খাবার বিক্রির বাজার থেকে মানুষের শরীরে ঢুকে পড়ে সেই ভাইরাস। করোনার ছোবল যে এত ভয়াবহ হতে যাচ্ছে প্রথম দিকে তা কেউ কল্পনাতে আনেননি। জানুয়ারির প্রথম দুই সপ্তাহে একাধিক মানুষের শরীরে এই ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত হয় চীনা কর্তৃপক্ষ। শুরুতে স্বীকার না করলেও পরিস্থিতি যখন এক-দুই-চার করে ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে তখন নতুন এক ধরনের ভাইরাস সংক্রমণ ঘটাচ্ছে বলে স্বীকার করে চীন।
চীনের ওই স্বীকারোক্তির পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তারা উহানে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে বিশ্ব নেতাদের নতুন এই লুকায়িত শত্রুর ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়। ততদিনে এই ভাইরাসের বিস্তার ঘটেছে প্রতিবেশি দক্ষিণ কোরিয়া, চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হংকংয়ে। প্রায় ৭৯ দিনে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস এখন বিশ্বের ১৭৩টি দেশ ও অঞ্চলে হানা দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে এই ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত দুই লাখ ৫৬ হাজার ৮০২ এবং মারা গেছেন ১০ হাজার ৫৪০ জন।
শুধুমাত্র চীনেই আক্রান্ত হয়েছেন ৮০ হাজার ৯৬৭ এবং মারা গেছেন তিন হাজার ২৪৮ জন। উহানে যখন এই ভাইরাসের বিস্তার দ্রুতগতিতে ঘটতে থাকে তখন দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট সরকার হুবেই প্রদেশকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ভাইরাসের বিস্তার চূড়ায় পৌঁছানোর আগে দেশটির ৩০টি প্রদেশের ৪২ হাজার চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীকে উড়িয়ে আনা হয়। করোনা রোগীদের চিকিৎসায় শুধুমাত্র উহানেই জরুরি ভিত্তিতে ১৪টি অস্থায়ী আধুনিক সব সুবিধা সম্বলিত হাসপাতাল তৈরি করা হয়।
চীন সরকারের নেয়া আগ্রাসী ব্যবস্থায় মানুষের ঘর থেকে বের হওয়াও নিষিদ্ধ করা হয়। স্বেচ্ছাসেবী কিংবা সরকারি কর্মীরা মানুষের বাসায় বাসায় গিয়ে খাবার এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দেন। চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী এবং অন্যদের রাত-দিনের টানা প্রচেষ্টা ও সেবায় চীন এই ভাইরাসের লাগাম টানতে সক্ষম হয়।
গত তিনদিন ধরে উহানে নতুন করে একজনকেও করোনা সংক্রমিত হিসেবে শনাক্ত করা যায়নি। তবে বিদেশ থেকে যারা চীনে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে প্রতিদিনই করোনা রোগী পাওয়া যাচ্ছে। নতুন রোগী না পাওয়ায় বৃহস্পতিবার উহান ছেড়েছেন দেশটির নানা প্রান্তের ৪২ হাজার চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী। স্বাস্থ্যখাতের এই যোদ্ধাদের বীরের মর্যাদায় বিদায় জানিয়েছেন উহানের বাসিন্দারা।
তারা যখন উহানের বুক চিড়ে গাড়িতে করে নিজ নিজ অঞ্চলে যাচ্ছিলেন; তখন শত শত মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্যালুট জানিয়ে বিদায় জানান। চিকিৎসাকর্মীদের বিদায়বেলায় উহানের রাস্তায় অনেককে কান্না করতে দেখা যায়। অজানা-অদেখা শত্রুর বিরুদ্ধে প্রাণ হারানোর ঝুঁকি নিয়ে লড়াই চালিয়ে সফল হওয়া যোদ্ধাদের প্রতি ভালোবাসার এই কান্না বিরল!
এসআইএস/এমএআর/বিএ