সিরিয়া সংকটের সমাধান ইউরোপের হাতে
২০১১ সালে সিরিয়ায় যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয় তখন সে দেশের জনসংখ্যা ছিল ২২ মিলিয়ন বা দুই কোটি ২০ লক্ষ। গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে এযাবৎ ৪০ লক্ষ মানুষ দেশান্তরিত হয়ে শরণার্থী হয়েছেন। আরও ৮০ লক্ষ মানুষ দেশের ভিতরেই উদ্বাস্তু হয়েছেন। হিসেব কষলে দেখা যায় দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষ গত ৪ বছরে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। আর দেশান্তরী হতে গিয়ে রক্ষণশীল হিসেবেও অন্তত তিন হাজার মানুষ ভূমধ্য ও ইজিয়ান সাগরে ডুবে মারা গেছেন, যাদের মধ্যে শিশু আয়লান কুর্দি ও তার বোন এবং তাদের মত অসংখ্য শিশুও রয়েছে।
আমরা দেখেছি সাদ্দাম হোসেন-উত্তর ইরাকে পুনর্গঠনের কাজ স্থানীয় বিবদমান গোষ্ঠীর ভ্রাতৃঘাতী হানাহানির কারণে বারবার কেবল ব্যাহত হয়নি, এক অর্থে তা ব্যর্থ হতেই চলেছে। সেখানে শূন্যতা সৃষ্টি না হলে ইসলামিক স্টেট কীভাবে ইরাকে এত শক্তিশালী হয়, এতটা জায়গা দখলে নেয়, এত নৃশংসতা চালায়? সিরিয়া আপাতত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের শেষ টার্গেট। সাদ্দাম, গাদ্দাফির মত বাশার আসাদকে এ পর্যায়ে তারা সর্বশেষ শিকার হিসেবে দেখতে চায়। বাশারকে রাশিয়া সমর্থন দিচ্ছে, ইরানও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ হল রাশিয়ার ভূমিকা ও সমর্থন। রাশিয়া কি পরাশক্তি হিসেবে তার হৃতসম্মান পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে সিরিয়াকেই পরীক্ষার গিনিপিগ।
হিসেবে বেছে নিচ্ছে? গিনিপিগের ওপর পরীক্ষা চালালে নিজের তেমন ক্ষতি নেই। পুতিন বলেছেন, সিরিয়াকে বাশার ও ইসলামি স্টেটের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে।বিপরীতে পশ্চিমা মিত্রশক্তির বক্তব্য হল, সিরিয়ার জন্যে দুটিমাত্র বিকল্প নয়, তৃতীয় বিকল্পটিই একমাত্র পথ। বাশার এবং ইসলামি স্টেট উভয়কেই পরাভূত করে উদারপন্থী বাজার অর্থনীতির সমর্থক সরকার বসাতে হবে।
এতে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার আশংকা এবং সিরিয়াবাসীর দুর্দশা অন্তহীন হয়ে উঠবে। ভয় হয় ভাবতে আরও কত লক্ষ মানুষের প্রাণ গেলে এবং দেশ গেলে তবে সিরিয়াবাসীর ‘বন্ধুরা’ শান্ত হবে।
বাঙালি কবির বাণী শিরোধার্য করেও কুহকিনী আশার ছলনে একটু হলেও সাড়া দেওয়া যায়। কারণ ইউরোপের শরণার্থী নেওয়ার এবং মানবতার দুঃখজনক বিপর্যয় সহ্য করার ক্ষমতার শেষপ্রান্ত দেখা যাচ্ছে। তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির ওপর সুবিন্যস্ত মলাট ভেতরকার সংকট ও তিক্ত চেহারা আর ঢাকতে পারবে না। কিন্তু ইউরোপ কি সভ্যতার বড়াই এমনি ছেড়ে দেবে? এখানেই সিরিয়াবাসীর জন্যে সামান্য সম্ভাবনার আলো দেখা যাচ্ছে। আবার ইউরোপে কিছু মৌলিক সংকটও দেখা দিয়েছে। যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা ছাড়ে নি, নতুন নির্বাচনও গ্রিসের সংকট থামাতে পারবে না এবং খোদ ইউরোপের পূর্ব ও পশ্চিমের দেশের মধ্যে বিভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এগুলোকে এড়িয়ে ইউরোপ কীভাবে সব দিক রক্ষা করবে তাই সামনের কয়েকটি দিনে দেখতে হবে। সময় খুবই কম। তাদের অত্যন্ত দ্রুততার সাথে সমস্যার জট খুলতে হবে এবং সম্ভবত চির-ধরা ঐক্যের বাঁধনটা সময়মত সারাতে হবে। এ ছাড়া ইউরোপের জন্যে অন্য বিকল্প নেই বলেই মনে হয়।
জার্মেনি ইউরোপীয় ঐক্যের নেতার ভূমিকা নিয়েছে, চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল তাঁর চেষ্টা থামান নি। ফ্রান্স প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে সঙ্গে থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু সিরিয়া সংকট এবং তা থেকে উদ্ভূত অব্যাহত শারণার্থী প্রবাহ তাদের যেন ভাববারও সময় দিচ্ছে না। কৌশল নির্ধারণে এবং তা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তের জন্যে যে দূতিয়ালি, সংলাপ-আলাপ চালাতে হয় তার ফুরসৎ নেই। শরণার্থীর চাপে গ্রিস, বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, হাঙ্গেরি জেরবার। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং পশ্চিমের সাথে সম্পর্কে টানাপোড়েন বাড়ছে। ইউরোপের স্বার্থে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ দ্রুত থামা দরকার। যুদ্ধ থামানো কি সমাধান? রাশিয়ার জন্যে হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে না। এখনও অবস্থা এরকমই। এ পর্যায়ে একমাত্র এই ভয়াবহ মানবিক ট্র্যাজেডি থামাতে পারে ইউরোপ, তার নিজের প্রয়োজনের জরুরি তাগিদ থেকে। ইউরোপে অস্থিরতা চলতে থাকলে, অনৈক্যই সত্য হয়ে দাঁড়ালে গোটা বিশ্বের ভবিষ্যত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা জানি না ইউরোপের দেশগুলো যুগপৎ ঐতিহাসিক ও মানবিক এই দায়িত্ব পালন করবে কিনা।
লেখক : কবি, চিন্তাবিদ।
এইচআর/এমএস