করোনাভাইরাস যেভাবে কেড়ে নিল এক ব্রিটিশ-বাংলাদেশির প্রাণ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৭:৪১ পিএম, ০৯ মার্চ ২০২০

করোনা আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাজ্যে গতকাল তৃতীয় যে ব্যক্তি মারা গেছেন, তিনি একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। শনাক্তের পাঁচদিনের মাথায় ম্যানচেস্টারের হাসপাতালে তিনি মারা যান। তার ছেলে বিবিসির কাছে বর্ণনা করেছেন কীভাবে ইতালিতে বেড়াতে গিয়ে তার বাবা করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হয়েছিলেন।

ওই বাংলাদেশির ছেলে বলেন, ‘প্রতি বছরের শুরুতে আমার বাবা ইতালিতে বেড়াতে আসেন দু-তিন সপ্তাহের জন্য। এটা তার একটা প্রিয় বেড়ানোর জায়গা। কারণ অনেক বছর তিনি ইতালিতে ছিলেন। ১৯৮৯ সালে তিনি বাংলাদেশ থেকে ইতালি আসেন। তখন তিনি বয়সে তরুণ।’

তিনি বলেন, ‘উত্তর ইতালির যে শহরে আমরা থাকতাম সেটা মিলান শহর থেকে ৫০ মাইল দূরে। সেখান থেকে সুইজারল্যান্ডের সীমান্তও বেশি দূরে নয়। বহু বছর আমরা সেখানে ছিলাম। আমার জন্ম সেখানেই। বড় হয়েছি সেখানে। পাঁচ-ছয় বছর আগে আমরা পাকাপাকিভাবে ব্রিটেনে চলে আসি।’

আমরা থাকি ম্যানচেস্টারের কাছে। কিন্তু আমার বাবা ইতালিতে বেড়াতে যেতে পছন্দ করতেন। আমরাও প্রতি বছর গ্রীষ্মে পরিবারের সবাই মিলে সেখানে বেড়াতে যেতাম। তবে বাবা প্রতি বছরের শুরুতে নিয়ম করে বেড়াতে যেতেন ইতালিতে তার পুরনো শহরে। এ বছরও গিয়েছিলেন।

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি তিনি সেখানে যান। তখনও ইতালিতে করোনাভাইরাস এত ব্যাপকভাবে ছড়ানোর কথা শোনা যায়নি। কিন্তু তিনি যে দুই সপ্তাহ ইতালিতে ছিলেন, তার মধ্যেই পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হয়। ব্যাপকভাবে সেখানে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।

গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বাবা ফিরে এলেন ইতালি থেকে। তখনও তিনি সুস্থ। কিন্তু তিন দিন পর সব যেন ওলট-পালট হয়ে গেল। মার্চের ৩ তারিখ, মঙ্গলবার ছিল অন্যদিনের মতোই। আমাদের বাড়ির কাছে যে হেলথ সেন্টার, বাবা সেখানে যান ডাক্তার দেখাতে। এই অ্যাপয়েন্টমেন্টটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল।

বাবার বয়স ছিল ৬০ বছর। তার নানা ধরনের অসুস্থতা ছিল, যা নিয়ে তিনি বেশ ভুগছিলেন। কোলেস্টরেল, আর্থ্রাইটিস, হৃদরোগ, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট। তবে এসবের পরও তিনি মোটামুটি ভালোই ছিলেন। তিনি একশভাগ সুস্থ ছিলেন, এটা বলা যাবে না, কিন্তু মোটামুটি ভালো ছিলেন।

করোনাভাইরাস নিয়ে যেহেতু আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল, তাই আমি কিছু মাস্ক কিনেছিলাম। আমি আমার মা-বাবাকে বললাম, বাইরে যাওয়ার সময় যেন তারা মাস্ক পরে বের হন।

Corona-Death-2.jpg

গত মঙ্গলবার বাড়ির কাছের হেলথ সেন্টারে যখন বাবা গেলেন, তখন ডাক্তার এবং নার্সরা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন তিনি মাস্ক পরে আছেন। তিনি বললেন, মাত্র দুদিন আগে তিনি ইতালি থেকে এসেছেন। সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো।

তাকে আলাদা করে ফেলা হলো। নর্থ ম্যানচেষ্টার জেনারেল হাসপাতাল থেকে একটা জরুরি দল চলে এলো। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। তার সঙ্গে আমাদের সেদিনই শেষ দেখা। আমরা বুঝতে পারিনি যে আর কোনদিন তার সঙ্গে আর দেখা হবে না।

হাসপাতালে প্রথম কয়েকদিন তিনি বেশ ভালোই ছিলেন। কিন্তু তারপর ডাক্তাররা বলছিলেন, তার রক্তে যথেষ্ট অক্সিজেন যাচ্ছে না। তার হার্টবিট অনিয়মিত। এভাবেই চলছিল কয়েকদিন। তারপর রোববার তিনি মারা গেলেন।

এদিকে বাড়িতে আমাদেরও রীতিমত আলাদা করে রাখা হয়েছিল। আমরা ঘর থেকে বেরুতে পারছিলাম না। কোথাও যেতে পারছিলাম না। বাবার খবরাখবর আমরা পেতাম টেলিফোনে। যে ওয়ার্ডে তাকে রাখা হয়েছিল, সেখানে ফোন করে খবর পেতাম। আমরা তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারতাম না।

গতকাল রোববার সকালে হাসপাতাল থেকে ফোন এলো আমাদের কাছে। তারা বললো, আধ ঘন্টা আগে বাবা মারা গেছেন। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। খবরটা শুনে ধাতস্থ হতে আমার কয়েক ঘন্টা সময় লেগেছিল। আমার বাবাকে আমি আর কোনদিন দেখতে পাবো না!

এরকম একটা খবর যখন আপনি পান, সেটা বুঝতেই আপনার অনেক সময় লেগে যায়। আমি ছিলাম শোকাহত। আমাদের বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেল। বাবার মৃত্যুর খবর পেলেও আমরা কিছুই করতে পারছি না, কোথাও যেতে পারছি না। কারণ আমাদের সবাইকে ‘আইসোলেশনে’ রাখা হয়েছে।

প্রতিদিন পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড থেকে আমাদের সবার কাছে টেক্সট আসে। তারা জানতে চায়, আমাদের সব ঠিক আছে কিনা। আমাদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কোন লক্ষণ আছে কিনা। প্রতিদিন আমাদের সেই টেক্সটের জবাব দিতে হয়।

এখন পর্যন্ত আমরা সবাই ভালো আছি। আমাদের কারো মধ্যে করোনাভাইরাসের কোন লক্ষণ নেই। আমরা এক সপ্তাহ এই অবস্থায় আছি। আরও এক সপ্তাহ থাকতে হবে। আমরা যেহেতু আইসোলেশনে আছি, তাই আমার বাবার জানাজা বা দাফন কোন কিছুই করতে পারছি না।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা লাশ আরও কিছুদিন মর্গে রেখে দেবে । আরও এক সপ্তাহ পর যখন আমাদের মুক্তি মিলবে, তখন আমরা বাবার জানাজা, দাফন এগুলোর আয়োজন করতে পারবো। আমরা এখনো জানি না, তার জানাজা-দাফন এগুলো আমরা স্বাভাবিকভাবে করতে পারবো কিনা।

কারণ তিনি তো স্বাভাবিকভাবে মারা যাননি। পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড যা বলে, সেই মতই আমাদের কাজ করতে হবে। মাত্র দুমাস আগেও আমরা জানতাম না করোনাভাইরাস জিনিসটা কী, এই ভাইরাসটাই ছিল না। এখন এই ভাইরাস আমার বাবাকে কেড়ে নিল।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এসএ/এমএস

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।