বিশ্ব অর্থনীতিতে যেভাবে প্রভাব ফেলবে করোনাভাইরাস

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:৩৮ পিএম, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ব্যয় কম, কারখানা বন্ধ, ভেঙে পড়ছে বিশ্বের পণ্য সরবরাহের শৃঙ্খল। করোনাভাইরাস সংকটে শুধু চীনই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুরো বিশ্ব। তবে এর সর্বোচ্চ প্রভাব এখনও পড়েনি। হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই তা শুরু হবে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।

চীন তো বটেই, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস অন্যান্য দেশেও ছড়াচ্ছে দ্রুতগতিতে। মঙ্গলবার পর্যন্ত সারাবিশ্বে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯২ জনে। শুধু চীনেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ২৪ হাজার ৩২৪ জন। আরও অন্তত ২৪টি দেশে ১৭৬ জনের শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। হংকং ও ফিলিপাইনে এই ভাইরাসে মারা গেছে দুজন। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী ১০ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে এ সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছতে পারে।

বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার কারণে করোনাভাইরাসের উৎসস্থল চীনের হুবেই প্রদেশে অন্তত সাড়ে চার কোটি মানুষ অবরুদ্ধ। ভাইরাস সংক্রমণের ফলে বেইজিং নববর্ষের ছুটি বাড়িয়েছে, শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরুর দিন পিছিয়েছে। প্রায় ১০ দিন বন্ধ থাকার পর গত সোমবার শেয়ারবাজার খুললেও প্রথম দিনই মুখ থুবড়ে পড়ে লেনদেন। যদিও মঙ্গলবার সেই ধাক্কা কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে।

jagonews24

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ও তারল্য সংকট কাটাতে সোমবার ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ইউয়ান বাজারে ছেড়েছে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি শুল্কেও ছাড় দিচ্ছে দেশটি।

অফিস-কারখানা বন্ধ

ভাইরাসে ভুক্তভোগী শুধু চীনের শেয়ারবাজারই নয়, অন্যান্য খাতেও রীতিমতো ধস নেমেছে। নববর্ষের বড় বড় সব আয়োজন বাতিল করা হয়েছে, পর্যকদের আনাগোনা নেই, বন্ধ সিনেমা হলগুলো। চীনজুড়ে স্টারবাকসের দুই হাজার আউটলেট বন্ধ, একই অবস্থা ম্যাকডোনাল্ডসের শতাধিক রেস্টুরেন্ট, ইউনিক্লোর ১৩০টি ও আইকিয়ার সব দোকানে।

মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে চীনের পর্যটন খাত। বেশ কয়েকটি দেশ চীনভ্রমণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছে। ফ্লাইট বাতিল করেছে বেশিরভাগ বিমানপরিবহন সংস্থা। লুফথানসা, এর সহযোগী সুইস এবং অস্ট্রিয়ান এয়ারলাইন্স বেইজিং যাওয়া-আসার সব ফ্লাইট আগামী ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাতিল করেছে। চীনা কর্তৃপক্ষ দেশটির নাগরিকদের আপাতত বিদেশ ভ্রমণ স্থগিত করতে বলেছে এবং নিজ দেশে ভ্রমণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছে।

চীনে চলতি সপ্তাহেও বন্ধ থাকছে বেশিরভাগ অফিস, কল-কারখানা। ভক্সওয়াগেন, বিএমডব্লিউ, ভলভো, টয়োটা, টেসলাসহ বেশিরভাগ গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তাদের বাৎসরিক ছুটি বৃদ্ধি করেছে। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ তেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান চীনের সিনোপেক উৎপাদন কমিয়ে প্রতিদিন ছয় লাখ ব্যারেলে নামিয়ে এনেছে।

সার্স থেকে শিক্ষা

২০০২ সালের দিকে চীনে ছড়িয়ে পড়েছিল সার্স (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম) ভাইরাস। সেই সময় দেশটির অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, ধস নেমেছিল শেয়ারবাজারে। তবে ১৭ বছর পর দেশটির অর্থনীতি এখন অনেক বড়। সার্সের সময় বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবদান ছিল পাঁচ শতাংশের মতো। আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে তাদের অবদান ১৬ শতাংশেরও বেশি। সুতরাং স্পষ্টতই চীন এখন বিশ্ব অর্থনীতির জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

jagonews24

আইএফও ইনস্টিটিউটের অথনৈতিক বিশেষজ্ঞ টিমো ওলমারশসার বলেন, অর্থনীতির এবারের পরিণতি সার্স মহামারির চেয়েও ভয়াবহ হবে। ছয় মাসের মতো দীর্ঘস্থায়ী ওই সংকট চীনের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কমিয়ে দিয়েছিল এক শতাংশের মতো। এরপর থেকে দেশটির অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। ফলে এবারের ক্ষতির হার আরও বড় হবে।

বড় দুর্ভোগ সামনে?

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের ক্ষয়ক্ষতি এখনও অনেক বাকি। বেইজিংয়ে জার্মান চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক জেন্স হিডেলব্রান্ট বলেন, নববর্ষ ও বসন্ত উৎসব উপলক্ষে চীন এমনিতেই অচল ছিল। সব কারখানা তিন থেকে চার সপ্তাহ ধরে বন্ধ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পর্যটন বাদে বাকি সব শিল্পই স্থবির হয়ে পড়েছিল।

তিনি বলেন, চীনা সরকার ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটি বাড়িয়েছে, কোনও কোনও শহরে তা ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। ফলে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চাকরি ও উৎপাদনের ওপর কী প্রভাব ফেলবে তা আগামী সপ্তাহ বা এর পরের সপ্তাহ থেকে দৃষ্টিগোচর হবে। কারণ, অভিবাসী কর্মীদের একটা বড় অংশই আসে উহান অঞ্চল থেকে; যা পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে আছে। কেবল আগামী সপ্তাহেই পরিষ্কার হবে সাংহাই, বেইজিং ও চীনের দক্ষিণাঞ্চলে কতজন কাজে যোগ দিতে যাবে এবং উৎপাদন ও আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খলায় ভাইরাসটি কতটা ক্ষতি করবে।

সরবরাহ শৃঙ্খলে আঘাত

জার্মানির ফরেন ট্রেড সার্ভিসেসের কর্মকর্তা জেরাল্ড উলফ বলেন, কিছুটা দেরি হলেও সরবরাহ শৃঙ্খল পুরোপুরি ভেঙে পড়বে এমন কোনও সম্ভাবনা এখনও দেখছি না। সুতরাং, ভয়ের কোনও কারণ নেই। জার্মান প্রতিষ্ঠানগুলো করোনাভাইরাস সংকট নিয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন নয় বলে জানান জেন্স হিডেলব্রান্ট। তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কিছু পরিকল্পনা করতে হলেও এই মুহূর্তে তারা শান্তই রয়েছে।

jagonews24

সতর্ক পদক্ষেপ নিচ্ছে জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চও (ডিআইডব্লিউ)। সংস্থাটির সভাপতি মার্সেল ফ্রাৎজার বলেন, করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে এত শিগগিরই সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। চীনসহ বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণ যদি প্রতিরোধ করা যায়, তাহলে অর্থনৈতিক ব্যয় কিছুটা সীমিত হবে এবং চীনে উৎপাদন ঘাটতি অল্প সময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

সরবরাহে ধস নামবে?

কিয়েল ইনস্টিটিউট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমির বিশেষজ্ঞ ক্লস-জার্গেন জার্ন বলেন, চীনে উৎপাদন বন্ধ দীর্ঘায়িত না হলেও এটি আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খলকে বড় ধরনের ঝুঁকিতে ফেলবে।

বাকি বিশ্বের জন্য চীন গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী দেশ। স্থবির অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে তা রাসায়নিক, মোটরগাড়ি, টেক্সটাইল ও ইলেকট্রনিক্স শিল্পের সরবরাহ শৃঙ্খল বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এমনটি হলে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ পাবে না এবং এর জন্য তাদের অন্য সরবরাহকারী খুঁজতে হবে। নতুবা উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে বলে সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদ জার্ন।

ঠিক এমনটাই হয়েছে গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হুন্দাইয়ের ক্ষেত্রে। প্রতিষ্ঠানটি মঙ্গলবার ঘোষণা দিয়েছে, আগামী সপ্তাহ থেকে তারা দক্ষিণ কোরিয়ায় গাড়ি উৎপাদন বন্ধ করে দিচ্ছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, গাড়িতে ব্যবহৃত তার না থাকায় তারা উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারছে না। এসব তার আসতো মূলত চীন থেকে। কিন্তু দেশটিতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার কারণে তার সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।

সূত্র : ডিডব্লিউ।

কেএএ/এসআইএস/এমকেএইচ

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।