চীনের সেন্সরশিপের কারণেই বেশি ছড়াচ্ছে করোনাভাইরাস
চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাস। দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এ পরিস্থিতিকে ‘মৃত্যুপুরী’র সঙ্গে তুলনা করেছেন। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমাতে উহান ও এর আশপাশের শহরের বাসিন্দাদের চলাচল নিষিদ্ধ করেছে সরকার।
এছাড়া সব বাস, ট্রেন, বিমান এবং ফেরি চলাচলও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি যদি আরও ভয়াবহ বিপর্যয়ে পরিণত হয়, সেক্ষেত্রে জিনপিং ও তার কমিউনিস্ট সরকারের তথ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অনেক বেশি দায়ী বলে বিবেচিত হবে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে পল উলফোউইজ এবং আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের বৈদেশিক ও প্রতিরক্ষা নীতি বিষয়ক জ্যেষ্ঠ সহযোগী ম্যাক ফ্রস্টের একটি মতামত প্রকাশিত হয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে, ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই স্প্যানিশ ফ্লু ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের ওপর এর প্রভাব ধামাচাপা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সরকার ও সংবাদমাধ্যম যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। ভাইরাসে হাজার হাজার মানুষ মরতে থাকলেও লস অ্যাঞ্জেলসের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ঘোষণা করেন ‘ভয়ের কোনো কারণ নেই’, আর স্থানীয় পত্রিকা আরাকানসাস গেজেট অসুখটিকে বর্ণনা করেছিল ‘সেই পুরোনো জ্বর ও ঠান্ডা’ হিসেবে।
এমনকি ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নামটিও ছিল ভুয়া। ফ্রান্স, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে এই ভাইরাস ছড়ালেও যুদ্ধনীতি বজায় রাখতে সেই খবর চাপা পড়ে যায় সেন্সরশিপ ও সেল্ফ-সেন্সরশিপের আড়ালে (১৯১৭ সালে চীন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও তারা ময়দানে পাঠিয়েছিল শুধু বেসামরিক শ্রমিকদের)। বিশ্বযুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকা স্পেনের রাজা ত্রয়োদশ আলফনসে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরেই এর খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
১৯১৮ সালের বসন্ত থেকে ১৯১৯ সালের শুরু পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে স্প্যানিশ ফ্লু তিনবার তাণ্ডব চালায়, আর এতে সাহায্য করেছিল সেন্সরশিপ ও গোপনীয়তা। এর ফলাফলও ছিল ভয়াবহ: বিশ্বজুড়ে পাঁচ কোটি মানুষ মারা যায়, এর মধ্যে প্রায় সাত লাখই ছিল মার্কিন নাগরিক।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টি দেশটির জনগণের ভালো থাকার চেয়ে সমাজ নিয়ন্ত্রণেই বেশি মনযোগী হওয়ায় আজও সেখানে একই পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে চীনের স্বচ্ছ ও সহযোগিতাপরায়ণ মনোভাবসহ ভাইরাস আক্রান্তদের আইসোলেশনে পাঠানোর তথ্য প্রকাশ করায় চীনা কর্তৃপক্ষের প্রশংসা করেছেন মার্কিন স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিষয়ক মন্ত্রী অ্যালেক্স আজার। যদিও অন্যদিক থেকে বেইজিংয়ের আচরণ ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে।
চীনে কোনো স্বাধীন গণমাধ্যম নেই। সেখানে শান্তিপূর্ণ সময়েও কড়া সেন্সরশিপ জারি থাকে। ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে শিনজিয়াং অঞ্চলেও। সেখানে ‘পুনর্শিক্ষাকেন্দ্রে’ গাদাগাদি করে দশ লাখেরও বেশি উইঘুরকে আটকে রেখেছে চীনা সরকার। তিনজনের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর জানা গেলেও তাইওয়ানকে এই প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলোচনায় যোগ দিতে বাধা দিচ্ছে বেইজিং।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘গুজব ছড়ানো’য় বহু মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে চীনের পুলিশ। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঘোষণা দেয়ার মাত্র দু’দিন আগেই এক লাখেরও বেশি মানুষের জন্য ভোজন উৎসবের আয়োজন করেছিল উহান সরকার।
১০ জানুয়ারি সরকারি বিশেষজ্ঞরা রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম সিসিটিভি’কে জানিয়েছিলেন, ভাইরাস পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণে’ ও ‘স্থির অবস্থায়’ আছে। প্রথমবার করোনাভাইরাস ধরা পড়ার অন্তত তিন সপ্তাহ পার না হওয়া পর্যন্ত প্রাদুর্ভাবের বিষয়টি প্রথম পাতায় আনেনি উহানের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত পত্রিকাটি।
বিশ্লেষকরদের ধারণা, সরকারিভাবে এই ভাইরাসে আক্রান্তের যে সংখ্যা বলা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে আক্রান্তের সংখ্যা আরও কয়েক হাজার বেশি। ১৯১৮ সালের ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি যে, গোপনীয়তা মৃত্যু ঘটাতে পারে। চীনা কমিউনিজম এখন বিশ্বব্যাপী বিশাল স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ কী?
এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শুরুতে জ্বর ও শুষ্ক কাশি হতে পারে। এর সপ্তাহখানেক পর শ্বাসকষ্টও দেখা দেয়। অনেক সময় নিউমোনিয়াও হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা লাগে। তবে এসব লক্ষণ মূলত রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরই জানা গেছে।
সেক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার একদম প্রাথমিক লক্ষণ কী বা আদৌ তা বোঝা যায় কি-না তা এখনও অজানা। তবে নতুন এই করোনাভাইরাস যথেষ্ট বিপজ্জনক। সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের লক্ষণ থেকে এটি মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্তও নিয়ে যেতে পারে।
এই ভাইরাস বিপজ্জনক হয়ে উঠছে কারণ এ বিষয়ে এখনও ভালোভাবে জানা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে এই ভাইরাস কতটা বিপজ্জনক এবং এটা একজন থেকে আরেকজনের শরীরে কীভাবে ছড়িয়ে পড়ছে এ বিষয়গুলো এখনও পরিষ্কার নয়।
এখন পর্যন্ত এটা জানা সম্ভব হয়েছে যে, এই ভাইরাস থেকে নিউমোনিয়া হবার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই এটা অনেক ভয়াবহ হতে পারে। অপরদিকে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্ষমতা আরও প্রবল হচ্ছে এবং সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন।
চীনে এই ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ৫৮ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। অপরদিকে থাইল্যান্ডে ৮, জাপানে ৪, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪, যুক্তরাষ্ট্রে ৫, ভিয়েতনামে ২, সিঙ্গাপুরে ৫, মালয়েশিয়ায় ৪, নেপালে ১, ফ্রান্সে ৩, অস্ট্রেলিয়ায় ৫, কানাডায় ১, জার্মানিতে ১ এবং কম্বোডিয়াতে একজন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
কেএএ/টিটিএন/জেআইএম