সাইবার নিরাপত্তায় ঝুঁকি ‘হুয়াওয়ে’
চীনা প্রযুক্তি জায়ান্ট হুয়াওয়ের চেয়ে নিজেদের প্রযুক্তি পণ্যকে খুব কম প্রতিষ্ঠানই ভালো বলে উদাহরণ হিসেবে হাজির করেন। বিদেশি টেলিকম সামগ্রীর অখ্যাত আমদানিকারক থেকে বহুজাতিক এই কোম্পানি বিশ্বের সর্ববৃহৎ পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক সরঞ্জামের প্রস্তুতকারীর জায়গা দখল করে নিয়েছে।
চীনা এই কোম্পানির প্রযুক্তি পণ্য নির্মাণের দক্ষতা অন্যান্য দেশকে চিন্তায় ফেলেছে। অনেকে বলছেন, গুপ্তচরবৃত্তি এবং সাইবার অন্তর্ঘাতে চীনের পক্ষে কাজ করতে পারে এই কোম্পানি। এছাড়া এই কোম্পানির তৈরি প্রযুক্তি বিপদেও ফেলতে পারে। পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্কের জন্য যেসব যন্ত্রাংশ হুয়াওয়ে তৈরি করছে, সেসবের মাধ্যমে সেই নেটওয়ার্কের সবকিছুর ওপর নজরদারি করা যায়।
কে, কাকে, কখন, কোন জায়গা থেকে ফোন করছে এবং কোন রুটে ডাটা পাঠানো হচ্ছে- এমন সব কিছুই দেখা যায় হুয়াওয়ের নেটওয়ার্কে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে হুয়াওয়ে বিশ্ববাজারের অন্য প্রতিযোগীদের চেয়ে এগিয়ে থাকায় এই প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তি সুবিধার পাশাপাশি ভয়েরও কারণ খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে।
আমেরিকাতেও এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠান রয়েছে। হুয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতা রেন ঝেংফাই। তিনি চীনের সামরিক বাহিনীর সাবেক ইঞ্জিনিয়ার। তার মেয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা মেং ওয়াংঝুকে কানাডায় গ্রেফতারের নীল নকশাও যুক্তরাষ্ট্রের। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বাণিজ্যের দায়ে চলতি সপ্তাহে কানাডার আদালতে আবারও শুনানিতে অংশ নেবেন মেং। নিজেদের ফাইভ-জি ব্যবস্থার বাইরে হুয়াওয়েকে নিষিদ্ধ করতে মিত্রদের সঙ্গে জোর লবিং করছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ব্যাপারে চলতি মাসের শেষের দিকে যুক্তরাজ্য সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে চীনা এই প্রতিষ্ঠানকে ট্রান্সআটলান্টিক ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করে সবুজ সংকেত নাও দেয়া হতে পারে।
জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেল তার দলের অনেকের সাথে এই কোম্পানিকে দেশ থেকে তাড়ানোর পক্ষে। অন্যান্য দেশ যেমন- ব্রাজিল এবং ভারতও একই পথ বেছে নিতে পারে। প্রযুক্তি জায়ান্ট এই কোম্পানির বিরুদ্ধে শক্তিশালী মামলা ঝুলছে। হুয়াওয়ের কার্যক্রমে এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনও ত্রুটি ধরা পড়েনি। কিন্তু গুপ্তচরবৃত্তির কারণে অনেক বড় দেশ টেক চ্যাম্পিয়ন এই প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করছে না। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি চুরি এবং হ্যাকিংয়ের ভুরিভুরি অভিযোগ রয়েছে চীনের বিরুদ্ধে।
চীনা এই কোম্পানিকে ব্যবহার করে একই ধরনের কাজ দেশটির সরকার করবে না; এমন ভাবনা বোকামির নামান্তর। দেশটিতে এক দলীয় স্বৈরশাসন চলছে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের শাসনামলে দেশে ও বিদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী আচরণ ফুটে উঠেছে। হুয়াওয়ে জোর দিয়ে বলছে, তারা বিদেশে গুপ্তচরবৃত্তিতে সহায়তা করে না।
এমনকি এ ধরনের কোনও অনুরোধ এলেও তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। কোম্পানিটির এই অবস্থানের ব্যাপারে উদার ব্যাখ্যা হলো, হুয়াওয়ের কর্মকর্তারা মুখ রক্ষার জন্য এই যুক্তি দিচ্ছেন। তবে হুয়াওয়ের এ ধরনের ঔদ্ধতপূর্ণ অবাধ্যতা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মেনে নেবেন; এমনটা কাল্পনিক ছাড়া কিছুই হতে পারে না।
এতসব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সত্ত্বেও বিশ্ববাজারে চীনা এই কোম্পানিকে প্রতিযোগিতা করতে দেয়া উচিত বলে মনে করে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট। ব্রিটিশ এই সাময়িকী বলছে, হুয়াওয়ের পণ্য উচ্চমানের এবং সস্তা। প্রতিষ্ঠানটিকে বাদ দেয়াটা হবে ব্যয়বহুল এবং ফাইভ জি নেটওয়ার্ক বিলম্বিত হওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে। এর ফলে বিশ্বায়নের ধারণা বাতিলে চাপ তৈরি হবে।
ইকোনমিস্ট বলছে, প্রযুক্তি শিল্পে ব্যয় হ্রাস এবং অগ্রগতিতে অবদান রাখছে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও হুয়াওয়ের প্রযুক্তির প্রকৃত ঝুঁকি রয়েছে; তারপরও সেই ঝুঁকি নিরসনে ব্যবহারকারী দেশগুলো তিনটি বিস্তৃত কৌশল গ্রহণ করতে পারে।
প্রথমটি হচ্ছে প্রযুক্তিগত। এনক্রিপশনে উৎসাহ দেয়া হলে তা গুপ্তচরবৃত্তির উদ্বেগ কমাবে। এর মাধ্যমে ডাটা ইন্টারসেপ্ট করা হলে তা অর্থহীন হয়ে পড়বে। এই নেটওয়ার্কের সুরক্ষা গভীরভাবে করা যেতে পারে। যাতে তথ্য চুরির চেষ্টা হলে তা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ঠেকানো যায় এবং এই নেটওয়ার্ক ব্যবস্থায় অবৈধভাবে কেউ অনুপ্রবেশ করে তথ্য হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে তা প্রতিরোধ করা যায়।
এছাড়া এখানে ব্রিটেনের উদাহরণ বিশেষভাবে দেয়া যেতে পারে। কারণ দেশটি তাদের স্পর্শকাতর নেটওয়ার্ক থেকে হুয়াওয়েকে দূরে রাখার পরিকল্পনা করছে।
দ্বিতীয়ত, বিদ্যমান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উন্মুক্ততার দিকে বেশি করে উৎসাহ দেয়া উচিত। বর্তমান টেলিকম নেটওয়ার্কগুলো নিজেদের সরঞ্জামেই নির্মিত। ভবিষ্যতে তারা এক ধরনের সফটওয়ারের অংশ হয়ে যাবে। হার্ডওয়্যারের সঙ্গে আপোস করে উদ্বেগের অবসানের চেষ্টা করা উচিত তাদের।
একই সঙ্গে বিশ্ববাজারে নতুন নতুন কোম্পানির প্রতিযোগিতার পথ সহজ করতে হবে। মুক্ত উৎসের বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে। টেক কোম্পানিগুলোর একটি জোট অ্যান্টেনা এবং মাস্টসের উন্মুক্ত উৎস তৈরিতে আগ্রহী। এর ফলে মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরেও একটি কাঠামো দাঁড় করানো যাবে। কোড এবং উন্মুক্ত ডিভাইসের কারণে নিরাপত্তায় কোনও ত্রুটি থাকলে সেটি সহজে ধরা পড়বে। ওপেন সোর্স সফটওয়্যার ইতোমধ্যে ইন্টারনেটকে আরও বেশি শক্তিশালী করেছে। আর এই ব্যবস্থা টেলিকম নেটওয়ার্ক কোম্পানিগুলো যত বেশি ব্যবহার করবে, ততই ভালো।
তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক পারস্পরিক সহযোগিতা এক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। ব্রিটেন ইতোমধ্যে হুয়াওয়ের সব ধরনের প্রযুক্তির বিরুদ্ধে নিজস্ব অনুসন্ধান চালিয়েছে। এর ফলাফল এবং অভিজ্ঞতা যত ব্যাপকভাবে প্রকাশ করা হবে, হুয়াওয়ে তত বেশি সৎ থাকতে বাধ্য হবে। সাধারণ একটি মানদণ্ড প্রতিষ্ঠায় ইউরোপের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানানো হচ্ছে। এমনকি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার আদলে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত সংস্থার প্রতিষ্ঠা, এক্ষেত্রে ভালো ধারণা হতে পারে।
যদিও এই সময়ে এসে বহুজাতিক এমন চিন্তা-ভাবনাকে অনেকে সেকেলে হিসেবে মনে করতে পারেন। তবে এটি হতে হবে সবার আগ্রহেই। তখন ক্রেতারা পুনরায় আশ্বস্ত হবেন যে, তারা আপসকৃত কোনও সরঞ্জাম কিনছেন না এবং বিক্রেতারাও তাদের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ দিতে সক্ষম হবেন।
অন্যান্য নিরাপত্তার মতো কম্পিউটার নিরাপত্তাও গুরুত্বপূর্ণ। তবে নেটওয়ার্কের সুরক্ষার জন্য একেবারে হুয়াওয়েকে নিষিদ্ধ করে দিয়ে এই নেটওয়ার্কে কোনও আক্রমণ হবে না; এমন ভাবনার অবকাশ নেই। নেটওয়ার্কে ত্রুটি উদ্বেগের কারণ হতে পারে। অধিকাংশ হ্যাকাররা ডিজিটাল ডিভাইসে সামান্য ত্রুটির সূত্র ধরে হানা দিতে পারে। এক্ষেত্রে রাশিয়ার উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। দেশটির নিজস্ব কোনও প্রযক্তি কোম্পানি নেই। যা তাদের দেশের হ্যাকারদের কাজে কোনও বাধাও তৈরি করছে না। একই কথা প্রযোজ্য ইরান এবং উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রেও।
শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি এবং অনুসন্ধানযোগ্য সরঞ্জামের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে নেটওয়ার্ক দাঁড় করানো এবং জ্ঞানের আদান-প্রদান বিশ্বের যে কোনও দেশের হ্যাকারের জীবনকে কঠিন করে তুলতে পারে। এটা শুধু চীনের ক্ষেত্রেই নয়, বরং সব দেশের হ্যাকারের জন্য। হুয়াওয়ে যদি টিকে না থাকে তারপরও এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হলে সেগুলো স্বার্থক হবে।
সূত্র : ইকোনমিস্ট।
এসআইএস/জেআইএম