আন্তর্জাতিক আদালতের আদেশ লঙ্ঘন, মিয়ানমারে ফের রোহিঙ্গা হত্যা
রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় গত বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চারটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)। এতে রোহিঙ্গা হত্যা বন্ধের কড়া নির্দেশ থাকলেও মাত্র দু’দিনের মাথায় তা অমান্য করেছে মিয়ানমার।
শনিবার কোনো ধরনের সংঘাত বা উসকানি ছাড়াই নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর কামান হামলা চালিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। এতে দুই নারী নিহত এবং অন্তত সাতজন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে এক অন্তঃসত্ত্বা নারী ছিলেন। বার্তাসংস্থা রয়টার্স এ তথ্য জানিয়েছে।
উত্তর রাখাইনের বুথিডং এলাকার সংসদ সদস্য মং কিয়াউ জান জানান, মধ্যরাতে কিন টং গ্রামে কোনও ধরনের লড়াই ছাড়াই পার্শ্ববর্তী ব্যাটালিয়ন থেকে আচমকা কামান হামলা চালানো হয়। এ নিয়ে চলতি বছরে দ্বিতীয়বারের মতো রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হলো।
সো তুন ও নামে এক রোহিঙ্গা জানান, হামলায় দু’টি বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। তিনি বলেন, সেনারা সব সময় ভারী অস্ত্র দিয়ে গুলি করে… এলাকায় যাকে সন্দেহ হয় তাকেই গুলি করে। আমরা আতঙ্কে থাকলেও এই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে ছেড়ে যাওয়া একেবারে অসম্ভব।
শনিবারের ওই হামলার বিষয়ে রয়টার্সের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দুই কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। তাদের ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও, খুন, ধর্ষণের মুখে ৭ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রাখাইনে এখনও আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মানবেতর জীবনযাপন করছে।
তারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না, শিক্ষা-চিকিৎসা সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। চলতি বছরের শুরুতেই বিদ্রোহীদের সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ চলাকালে বিস্ফোরণে চার শিশু প্রাণ হারায়। মিয়ানমা সামরিক বাহিনী এই অভিযান গণহত্যার অভিপ্রায়ে পরিচালনা করছে বলে মন্তব্য করেছে জাতিসংঘ।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের নভেম্বরে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ বিচারিক সংস্থা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ এনে মামলা করে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া।
যেভাবে মামলার তদন্ত
গত সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মিয়ানমারের বিচারের এখতিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আছে বলে সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। চলতি বছরের মার্চে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর ফাতো বেনসুদা মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নেন।
এরপর গত ৪ জুলাই রোহিঙ্গাদের ওপর যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে তদন্ত শুরু করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) অনুমতি চান প্রসিকিউটর ফাতো। জুলাইয়ে তার তদন্ত দল বাংলাদেশে এসে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছ থেকে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করে।
এরপর প্রাথমিক তদন্ত শেষে পূর্ণ তদন্তের জন্য আবেদন করেন ফাতো বেনসুদা, যাতে সায় দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারকরা। ফলে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিপীড়নের ঘটনায় কোনো আন্তর্জাতিক আদালতে তদন্ত শুরু হয়।
আন্তর্জাতিক আদালতের আদেশ
গত ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। গাম্বিয়ার পক্ষে মামলার শুনানিতে নেতৃত্ব দেন দেশটির বিচার বিষয়ক মন্ত্রী আবুবকর তামবাদু। অন্যদিকে মিয়ানমারের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন দেশটির নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চি।
গত বৃহস্পতিবার নেদারল্যান্ডসের রাজধানী দ্য হেগে বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টার পর আইসিজের প্রধান বিচারপতি আবদুল কাভি আহমেদ ইউসুফ সর্ববম্মতিক্রমে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চারটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
ওই নির্দেশগুলো হলো-
>> মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা হত্যা বন্ধসহ গণহত্যার প্রচেষ্টা বা ষড়যন্ত্র না করার জন্য দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ।
>> রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, সেব্যাপারে আন্তর্জাতিক আদালতের কাছে আগামী চার মাসের মধ্যে মিয়ানমারকে অবশ্যই প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। প্রথম প্রতিবেদন দাখিলের পর প্রতি ছয় মাস পরপর একই ধরনের প্রতিবেদন আদালতের কাছে উপস্থাপন করতে হবে।
>> গাম্বিয়া ওই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আদালতের কাছে প্রয়োজনীয় বিষয়ে আবেদন করতে পারবে।
>>মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়নের প্রমাণাদি সংরক্ষণ করতে হবে।
এছাড়া, গণহত্যা সনদের ২নং ধারা অনুসারে রোহিঙ্গাদের বিশেষ সুরক্ষার অধিকারী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করার প্রস্তাব দেন আন্তর্জাতিক আদালত।
এর আগে, আদেশ ঘোষণার শুরুতে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলার পক্ষে রোহিঙ্গা নিপীড়ন ও গণহত্যার যেসব আলামত আদালতের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছিল, সেসব বিরোধের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন বিচারপতি ইউসুফ।
সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি, এএফপি, আলজাজিরা।
কেএএ/টিটিএন/জেআইএম/এমএস