সোলেইমানি হত্যার নীলনকশা ও ৫৫০ কোটির মার্কিন ড্রোন
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে ইরানের কুদস ফোর্সের প্রধান লে. জেনারেল সোলেইমানি এবং ইরাকের হাশদ আল-শাবি নামে পরিচিত পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিটের (পিএমইউ) প্রধান আবু মাহদি আল-মুহানদিস ও তাদের আট অনুসারী গত শুক্রবার বাগদাদ বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার সময় যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হন।
ইরানি জেনারেল ও তাদের অনুসারীদের হত্যা করা হয়েছে অত্যাধুনিক একটি ড্রোনের মাধ্যমে। এম কিউ-নাইন রিপার নামের ড্রোনটি সোলেইমানির গাড়িবহর লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। ড্রোনটির দাম ৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৫৫০ কোটি টাকার সমান। ঘাতক এই ড্রোনটির ক্ষমতাও বেশ চমক জাগানিয়া।
জেনারেল কাসেম সোলেইমানি বাগদাদ বিমানবন্দরে নামার আগেই তার মৃত্যুর পরোয়ানা জারি হয়েছিল। ওই অভিযানের ব্যাপারে অবগত এক মার্কিন কর্মকর্তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ক্ষমতাধর ইরানি জেনারেলকে হত্যার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল বৈরুতে, ঘটনার একদিন আগে বৃহস্পতিবার। তখন তিনি লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ছিলেন।
মার্কিন ওই কর্মকর্তা জানান, লেবাননের রাজধানী বৈরুতে থাকার সময়ই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের গোয়েন্দারা সোলেইমানির বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে ইরাকে যাওয়ার সফরসূচি সম্পর্কে জানতে পারে। সফরসূচি হাতে পাওয়ার পর থেকেই তাকে হত্যায় নীলনকশা কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু করে মার্কিন বাহিনী।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা এই হামলায় নিয়োজিত করে ‘চৌকস’ এম কিউ-নাইন রিপার নামের ওই ড্রোন। যা একবার জ্বালানি নিলে ১৮০০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত হামলা চলতে পারে। এর গতি ঘণ্টায় ৪৮২ কিলোমিটার। অত্যাধুনিক ইনফ্রারেড ক্যামেরা থাকায় রাতেও স্পষ্ট ছবি তুলতে পারে ড্রোনটি, যা চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন ঘাঁটিতে।
আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে ড্রোন অপারেশন পরিচালনাকারী মার্কিন সেনা ব্রেট ভেলিকোভিচ বলেন, ‘রিপার ড্রোন তার ক্যামেরা দিয়ে সোলেইমানিকে সহজেই চিহ্নিত করতে পেরেছে। কেননা ড্রোনটির ক্যামেরা শত শত মাইল দূর থেকে গাড়ির ভেতরে থাকা যেকোনো ব্যক্তির অবস্থান, এমনকি সেই ব্যক্তি কী পোশাক পরে আছেন তাও চিহ্নিত করতে পারে।
দেশের সীমানার বাইরে ইরানের আধিপত্য বিস্তারের কারিগর সোলেইমানি ইরাকে ঢোকার জন্য বেশকিছু পয়েন্ট ব্যবহার করতেন। সেটা কখনো আকাশপথ তো কখনো সীমান্ত পথ। তার এই আসা যাওয়ার খবর কেউ কখনোই জানতো না। গত শুক্রবারের মতো কদাচিৎ তিনি বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে ইরাকে ঢোকেন।
ইরান সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর এক নেতা জানান, ‘বৃহস্পতিবার সোলেইমানি যখন তেহরান থেকে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে পৌঁছান তখন থেকেই তার ওপর নজরদারি করা শুরু হয়েছিল। শুক্রবার মধ্যরাতে বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ড্রোন হামলায় নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তার চলাচল নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়।’
সোলেইমানি তেহরান থেকে দামেস্ক বিমানবন্দরে পৌঁছান বৃহস্পতিবার সকালে। সিরিয়ার রাজধানী শহরে কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ না করেই সোজা প্রথমে বিমানে তারপর গাড়িতে করে বৈরুতে যান। সেখানে হিজবুল্লাহ’র সেক্রেটারি জেনারেল হাসান নাসারাল্লাহর সঙ্গে বৈঠক করেন ইরাকের সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে।
দামেস্ক হয়ে বৈরুতে যাওয়ার সময় থেকেই সোলেইমানির পিছু নেয় মার্কিন ও ইসরায়েলের গোয়েন্দারা। তবে বৈরুতে প্রয়োজনের চেয়ে এক মিনিটও বেশি অবস্থান করেননি তিনি। হিজবুল্লাহ নেতার সঙ্গে আলোচনা শেষে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যথেষ্ট গোপনীয়তার মাধ্যমে যেভাবে সেখানে গিয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই দামেস্কে ফিরে আসেন।
বৈরুত থেকেই সোলেইমানির প্রতিটি পদক্ষেপ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের গোয়েন্দারা। তারা কাসেম সোলেইমানির ফোনের কথোপকথনও শুনছিলেন। সোলেইমানি দামেস্ক ফিরলে সে খবর চলে যায় বাগদাদসহ যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট ঘাঁটিতে। পরিকল্পনা ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের পথে আগায় মার্কিন সেনারা।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতের আলি আল সালেম, কাতারের উদেদ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে আল দাফরে যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি ড্রোন ঘাঁটি রয়েছে। হামলা চালানো হয়েছে বাগদাদ বিমানবন্দরে সবচেয়ে পাশাপাশি কুয়েতের আলী আল সালেম ড্রোন ঘাঁটি থেকে। সেটিও বাগদাদ থেকে ৫৭০ কিলোমিটার দূরে। অন্য দুটি ঘাঁটির দূরত্ব আরও বেশি।
মার্কিন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা এ ধরনের অভিযানকে বলেন ‘টাইম সেনসেটিভ অপারেশন’। অর্থাৎ সময় সম্পর্কে যথেষ্ট হিসাব সতর্ক থেকে হামলা চালাতে হয়। গোয়েন্দা তথ্য না থাকলে কুয়েতের ৫৭০ কিলোমিটার দূরের ঘাঁটি থেকে বাগদাদে হামলা চালানো সম্ভব হতো না। তাই সোলেইমানির প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল কড়া নজরদারি আওতায়। আর সে তথ্য যাচ্ছিল কুয়েতের মার্কিন ঘাঁটিতে।
এদিকে বৈরুত থেকে দামেস্কে ফিরে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সেখান থেকে সিরিয়ার বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থা ছাম উইংসের একটি ফ্লাইটে ওঠেন সোলেইমানি। বিমানটি ছাড়ার কথা ছিল স্থানীয় সময় ৮টা ২০মিনিটে, কিন্তু অজানা কারণে বিমানটি প্রায় দুই ঘণ্টা দেরিতে রাত ১০টা ২৮ মিনিটে গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে।
ছাম উইংসের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, আকাশপথে দামেস্ক থেকে বাগদাদে পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র এক ঘণ্টা ৫ মিনিট। সোলেইমানি যে বিমানে আসছিলেন সেটি স্থানীয় সময় রাত ১২টা ৩২ মিনিটে বাগদাদে অবতরণ করে। সোলেইমানির সফরসঙ্গী ছিলেন দুজন, যাদের মধ্যে একজন তার জামাতা।
শুক্রবার মধ্যরাতে বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন ইরানের অভিজাত কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সোলেইমানি। তার আগে থেকেই বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন তার দীর্ঘদিনের বন্ধু এবং ইরাকে ইরানের বড় মিত্র আধাসামরিক বাহিনী হাশদ আল-শাবির উপ-প্রধান আবু মাহদি আল-মুহানদিস।
সোলেইমানি বিমানবন্দরে অবতরণের পর কোনো কালক্ষেপণ করতে চাননি। মুহানদিস ও বাকি অনুসারীদের নিয়ে গন্তব্যে যাত্রা শুরু করেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে তিনি সন্দেহ বাড়াতে চাননি। তাই তড়িঘড়ি করে গন্তব্যে যাত্রার কথা জানান অনুসারীদের। সংক্ষিপ্ত অভ্যর্থনা পর্ব শেষে দুটি গাড়িতে যাত্রা শুরু করেন তারা।
কিন্তু সোলেইমানি যখন বাগদাদ বিমানবন্দরে নামেন তখন তার মাথার ওপর ওত পেতে ছিল অপারেশনের শেষ অস্ত্র অর্থাৎ এম কিউ-নাইন রিপার ড্রোন। মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্যে এও জানা গেছে, ড্রোনটি থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা যদি ব্যর্থ হতো তাহলে প্রয়োজনে ড্রোন উড়িয়ে সোলেইমানিকে ধাওয়া করার পরিকল্পনাও ছিল।
হুন্দাই স্টার্ক মিনিবাসে নিরাপত্তারক্ষীদের নিয়ে টয়োটা আভালনে যাত্রা শুরু করেন সোলেইমানি ও মুহানদিস। দুটি গাড়ির মধ্যে দূরত্ব ছিল আনুমানিক ১০০-১২০ মিটার। ড্রোন থেকে ছোড়া প্রথম ক্ষেপণাস্ত্রটি নিরাপত্তারক্ষীদের হুন্দাই স্টার্কসে আঘাত হানে। দ্বিতীয়টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে ব্যর্থ হলেও তৃতীয় ক্ষেপণাস্ত্রটি সোলেইমানির টয়োটা আভালন তছনছ করে দেয়।
বিমানবন্দরে থাকা ইরাকের নিরাপত্তা বাহিনীর বক্তব্য অনুযায়ী, হামলার ঘটনাটি ঘটে আনুমানিক রাত ১টা ৪৫ মিনিটে। ২৩০ কিলোমিটার দূর থেকে হামলা চালানো হয় সোলাইমানির গাড়িতে। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে ঘটে বিস্ফোরণ। মুহূর্তেই ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় কাসেম সোলেইমানির।
এসএ/এমএস