সামরিক সক্ষমতায় কতটা শক্তিশালী ইরান?
বাগদাদ বিমানবন্দরে জেনারেল কাসেম সোলেইমানি নিহত হওয়ার পর কঠোর প্রতিশোধ নেয়ার অঙ্গীকার করেছে ইরান। যারা জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার পেছনে দায়ী তাদের জন্য কঠিন প্রতিশোধ অপেক্ষা করছে বলে হুমকি দিয়েছেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা। কিন্তু কতটা সক্ষমতা আছে ইরানের সামরিক বাহিনীর।
ইরানের সেনাবাহিনী কতটা বিশাল?
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সামরিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মতে, প্রায় ৫ লাখ ২৩ হাজার সক্রিয় সদস্য আছে ইরানের সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন স্তরে। এর মধ্যে ৩ লাখ ৫০ হাজার নিয়মিত আর বাকি কমপক্ষে এক লাখ পঞ্চাশ হাজার ইসলামিক রিভলিউশানারি গার্ড কর্পস বা আইআরজিসি।
এছাড়া আরও বিশ হাজার আছে আইআরজিসির নৌ বাহিনীতে। এই বাহিনী গোটা বিশ্বের অন্যতম বাণিজ্যিক রুট হরমুজ প্রণালিতে নৌকাসহ নানান নৌযানে সশস্ত্র টহল দেয়। এরা আইআরজিসি বাসিজ ইউনিটও নিয়ন্ত্রণ করে যারা মূলত স্বেচ্ছাসেবী ফোর্স।
মূলত অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ মোকাবিলায় তারা কাজ করে। এরা দ্রুত হাজার হাজার মানুষকে জমায়েত করতে পারে। আইআরজিসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৪০ বছর আগে যা পরে বড় সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। এটাকে ইরানর সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং অভিজাত বাহিনী বলে মনে করা হয়।
দেশের বাইরে অভিযান
আইআরজিসির সবচেয়ে চৌকসদের নিয়ে গঠিত কুদস ফোর্স যার নেতৃত্বে ছিলেন সম্প্রতি মার্কিন অভিযানে নিহত জেনারেল সোলেইমানি। কুদস বিদেশে অনেক গোপন অভিযান পরিচালনা করে এবং তারা সরাসরি দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির কাছে জবাবদিহি করে।
এই ইউনিটকেই সিরিয়াতে মোতায়েন করা হয়েছিলো যারা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ও সশস্ত্র শিয়া মিলিশিয়াদের সাথে একসঙ্গে যুদ্ধ করেছে। ইরাকে এই বাহিনী শিয়া নিয়ন্ত্রিত একটি আধাসামরিক বাহিনীকে সমর্থন করতো, যারা জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) পরাজয়ে সহায়তা করেছে।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র বলছে, কুদস ফোর্স অর্থ, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও উপকরণ দিয়েছে এমন সংগঠনকে যাদের যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে মনে করে। এরমধ্যে লেবাননের হিজবুল্লাহ আন্দোলন এবং ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদও রয়েছে। গত বছরের এপ্রিলে ইরানের আইআরজিসিকে সন্ত্রাসী তালিকাভূক্ত করে ট্রাম্প প্রশাসন।
তবে অর্থনৈতিক সমস্যা ও মার্কিন অবরোধ ইরানের অস্ত্র আমদানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। দেশটির প্রতিরক্ষা খাতে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যে পরিমাণ অস্ত্র আমদানি হয়েছে তা সৌদির আরবের মোট সামরিক আমদানির ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মাত্র। ইরান সবচেয়ে বেশি সমরাস্ত্র আমদানি করে রাশিয়া থেকে। এরপরই চীনের অবস্থান।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আছে?
হ্যাঁ ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আছে। ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের মতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড় বিশেষ করে স্বল্প পাল্লা আর মাঝারি পাল্লার ক্ষেত্রে। এছাড়া প্রতিনিয়ত তারা নতুন নতুন অস্ত্রের পরীক্ষাও চালাচ্ছে।
প্রতিরক্ষা বিভাগ আরও বলছে, ইরান স্পেস টেকনোলজি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে যাতে করে আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা যায়। তবে রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইন্সটিটিউট বলছে, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ইরান স্থগিত করেছিল ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির পর। তবে চুক্তির অনিশ্চয়তায় এটা আবার শুরু হতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রেই সৌদি আরব ও উপসাগরীয় এলাকার অনেক টার্গেট ইরানের স্বল্প বা মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের আওতাতেই আছে, বিশেষ করে ইসরায়েলে সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তুগুলো। এছাড়া তেহরানের আঞ্চলিক মিত্ররাও ইরানের সরবরাহ করা ক্ষেপণাস্ত্র ও গাইডেন্স সিস্টেম ব্যবহার করে বিশেষ করে সৌদি, ইসরায়েল ও আমিরাতের জন্য।
গত বছর মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র প্যাট্রিয়ট অ্যান্টি মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন করে মধ্যপ্রাচ্যে যা ইরানের সঙ্গে দেশটির উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেয়। প্যাট্রিয়ট হলো এমন এক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা যা পাল্টা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ক্রুজ মিসাইল ও অগ্রবর্তী এয়ারক্রাফট্রের সমন্বয়ে গঠিত।
অপ্রচলিত (নন কনভেনশনাল) অস্ত্র কোনগুলো
কয়েক বছরের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান তার ড্রোন সক্ষমতা বাড়িয়ে নিয়েছে। ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ২০১৬ সাল থেকেই ইরাকে ড্রোন ব্যবহার করে ইরান। ২০১৯ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ড্রোনকে ভূপাতিত করে তারা এই অভিযোগে যে ড্রোনটি ইরানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে।
বিবিসির প্রতিরক্ষা ও কূটনৈতিক সংবাদদাতা জোনাথন মার্কাস বলছেন, এর বাইরেও ইরান ড্রোন প্রযুক্তি তাদের মিত্রদের কাছেও স্থানান্তর বা বিক্রিও করেছে। ২০১৯ সালেই ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছিল সৌদির তেল ক্ষেত্রে। সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র এজন্য ইরানকেই দায়ী করেছিল। তবে তেহরান অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
বরং তারা ইয়েমেনের বিদ্রোহীদের দায় স্বীকারের দিকে ইঙ্গিত করেছে। ইরানের সাইবার সক্ষমতা আছে। ২০১০ সালে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ওপর বড় ধরনের সাইবার হামলার পর তারা সাইবার স্পেস সক্ষমতায় জোর দেয়। আইআরজিসিরি নিজস্ব সাইবার কমান্ড আছে বলে ধারণা করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইরান অ্যারোস্পেস কোম্পানি, প্রতিরক্ষা ঠিকাদার, এনার্জি ও ন্যাচারাল রিসোর্সেস কোম্পানি ও টেলিকম ফার্মগুলোকে তাদের বিশ্বব্যাপী সাইবার অপারেশনের কাজে টার্গেট করেছে।
এছাড়া ২০১৯ সালে মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট বলেছিল, ইরানভিত্তিক একটি হ্যাকার গ্রুপ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণাকে টার্গেট করেছিলো এবং তারা যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের অ্যাকাউন্টগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করেছিলো।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
এসএ/এমএস