জেনারেল সোলেইমানি কে ছিলেন?

হুসাইন আজাদ
হুসাইন আজাদ হুসাইন আজাদ
প্রকাশিত: ০২:৪৩ পিএম, ০৩ জানুয়ারি ২০২০

গোটা দুনিয়ায় এখন আলোচিত নাম কাসেম সোলেইমানি। ইরাকে মার্কিন বাহিনীর হামলায় ইরানের এই মেজর জেনারেল নিহত হওয়ার পর ঝাঁকুনি খেয়েছে বৈশ্বিক তেলের বাজার। শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) ভোরে জেনারেল সোলেইমানি নিহত হওয়ার কয়েকঘণ্টার মধ্যে তেলের দাম বেড়ে যায় ৪ শতাংশ। ইরানি জনগণের পাশাপাশি এই ঘটনার ‘পরিণতি’ নিয়ে শঙ্কিত পুরো বিশ্বমিডিয়া।

কে ছিলেন জেনারেল সোলেইমানি? কেন তাকে হত্যার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও পর্যন্ত সবাই উচ্ছ্বাসের টুইট করছেন? কেন দফায় দফায় বিবৃতি দিচ্ছে মার্কিন সরকার। এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। এতে কাসেম সোলেইমানির একজন ‘নিভৃতচারী’ অথচ ‘সবচেয়ে ক্ষমতাধর’ জেনারেল হয়ে ওঠার ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে।

কাসেম সোলেইমানির পরিচয়
ইরানের বিপ্লবী গার্ডের (আইআরজিসি) অভিজাত শাখা কুদস্ বাহিনীর প্রধান ছিলেন জেনারেল সোলেইমানি। অপ্রচলিত যুদ্ধের জন্য তৈরি কুদস্ বাহিনীকে বৃহৎ ‘স্পেশাল অপারেশন ইউনিট’ বলা যায়। ‘শত্রুর চোখে চোখ রেখে চলা’র নীতিতে বিশ্বাসী জেনারেল সোলেইমানি কুদস্ বাহিনীর প্রধান কর্মক্ষেত্র ইরানের বাইরে নিয়ে গিয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে তেহরানের যে সামরিক প্রভাব তৈরি করেছেন, তা তাকে দেশে এবং বিদেশে ‘জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব’র মর্যাদায় আসীন করেছে।

ইরানে বিপ্লবের পর যুগ-যুগ ধরে দেশটির ওপর পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তেহরান দিনে দিনে মধ্যপ্রাচ্যে যে উত্থানের গল্প লিখেছে, তাতে বড় অবদান এই সোলেইমানির। সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, সামরিক ভারসাম্যে পরিবর্তনের ছোঁয়া এনে ইরানের অর্থনীতিকে পতনের কিনার থেকে রক্ষা করেছেন তিনিই।

এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব ও ইসরায়েল সোলেইমানির তৎপরতা অনুমান করতে পারলেও তাকে থামাতে পারছিল না। যদিও গত ২০ বছরে সৌদি, ইসরায়েল ও পশ্চিমা কিছু দেশের বিভিন্ন সংস্থা সোলেইমানিকে গুপ্তহত্যার চেষ্টা চালায় বহুবার। কিন্তু শুক্রবারের আগে সববারেই তারা ব্যর্থ হয়।

Soleimani

যেভাবে সবচেয়ে পরাক্রমশালী জেনারেল হলেন
সোলেইমানির উঠে আসা ইরানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কেরমান প্রদেশের একটি দরিদ্র পরিবার থেকে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে পরিবারের সচ্ছলতার জন্য কাজ শুরু করেন তিনি। অবসরে ভারোত্তোলন চর্চার পাশাপাশি তৎকালীন খামেনীর অনুষ্ঠানগুলোতে উপস্থিত হতেন সোলেইমানি।

১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ্লবের সময় তরুণ সোলেইমানি প্রথম সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। মাত্র ছয় সপ্তাহ সামরিক প্রশিক্ষণ শেষ না করতেই ইরানের পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশে প্রথম যুদ্ধক্ষেত্রে নামতে হয় তাকে।

ইরান-ইরাক যুদ্ধের (১৯৮০-১৯৮৮) সময় সীমান্তে বীরোচিত ভূমিকার জন্য ‘জাতীয় বীর’ বনে যান সোলেইমানি। এরপর সামরিক বাহিনীতে তিনি হয়ে ওঠেন অন্যতম আস্থাভাজন জেনারেল।

এই আস্থাভাজন জেনারেলের হাতে ১৯৯৮ সালে তুলে দেয়া হয় বিপ্লবী গার্ডের প্রধানের দায়িত্ব। তারপর অনেকটা নিভৃতে তিনি কাজ করতে থাকেন। তার কৌশলের কারণে লেবাননের হেজবুল্লাহ, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুগত বাহিনী এবং ইরাকের শিয়াপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জোরদার সম্পর্ক গড়ে ওঠে ইরানের।

সোলেইমানির কুদস্ বাহিনী সাম্প্রতিক সময়ে ইরান সীমানার বাইরে কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সফলতার পরিচয় দিয়েছে সিরিয়া এবং ইরাকে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ যখন গৃহযুদ্ধের কারণে পতনের দ্বারপ্রান্তে, তখন সোলেইমানির নেতৃত্বে তার বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে কৌশলী ভূমিকা নেয়, এই ভূমিকার কাছে হেরে যায় আসাদবিরোদী সুন্নি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। এছাড়া ইরাকে এবং সিরিয়ার বিশাল অংশে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস দমনে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার পাশাপাশি সোলেইমানির বাহিনীও রাখে অনস্বীকার্য ভূমিকা।

দীর্ঘদিন নিভৃতে কাজ করলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনী ও অন্য শিয়া নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে দেখা যেতে থাকে। গত বছরের মার্চে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনী জেনারেল সোলেইমানিকে ‘অর্ডার অব জুলফিকার’ পদক দেন। বিপ্লব-পরবর্তী ইরানে এ পদক সোলেইমানিই প্রথম পান। এ অনুষ্ঠানের প্রচারিত ছবিতে দেখা যায়, সোলেইমানির ঘাড়ে চুম্বন করছেন খামেনী। শিয়া সংস্কৃতিতে এমন চুম্বনের প্রতীকী তাৎপর্য ব্যাপক।

জানা যায়, সোলেইমানি তার কুদস্ বাহিনীর কার্যক্রমের বিষয়ে জবাবদিহি করতেন কেবল আয়াতুল্লাহ আলী খামেনীর কাছে। সেজন্য খোদ ওই বাহিনীর সদস্যরাই তাদের সামর্থের ব্যাপারে পুরোপুরি স্পষ্ট ছিলেন না।

সিরিয়া-ইরাকে ইরানের উপস্থিতি
সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর পশ্চিমাদের তদারকিতে ইরাকে সরকার গঠিত হলে সেসময় ওই দেশের রাজনীতিতে ক্ষমতা বাড়াতে তৎপর হন সোলেইমানি। ইরাকের দুই প্রধানমন্ত্রী ইব্রাহিম আল-জাফরী ও নুরী আল-মালিকীর সময়ে তিনি এই তৎপরতা বেশি বাড়ান। ওই সময় ইরাকে ইরানের পুরোনো ‘ছদ্মবেশী শক্তি’ বলে পরিচিতি বদর অর্গানাইজেশনের রাজনৈতিক শাখা থেকে স্বরাষ্ট্র ও পরিবহনমন্ত্রী দায়িত্ব পেলে সোলেইমানির কীর্তি নজর কাড়ে তেহরানের।

অন্যদিকে ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে সোলেইমানি তার ছত্রছায়ায় থাকা ইরাকের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর একটি অংশকে বাশারের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য পাঠান। সেক্ষেত্রেও সফলতা এখন সবার সামনে। শিয়াপন্থি বাশার টিকে গেছেন আরব বসন্তের ঝড়েও।

এছাড়া আইএসের বিরুদ্ধে ইরাকের সামরিক বাহিনীর যুদ্ধের সময় তাদের সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠী হাশদ আল-শাবিও লড়ে সোলেইমানির নির্দেশনায়।

এই দুই যুদ্ধক্ষেত্রে জেনারেল সোলেইমানির ভূমিকা তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায় ইরানিদের কাছে। যেমন ইউনিভার্সিটি অব তেহরানের আমেরিকান স্টাডিজ বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ মারান্দি বলছিলেন, ‘আইএসকে পরাভূত করতে ভূমিকার জন্য ইরানি জনগণ ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যদেশগুলোর নাগরিকদের কাছে তিনি ‘জাতীয় বীর’ বনে গেছেন। তার মতো একজন দায়িত্ব না নিলে এই অঞ্চলে হয়তো কালো পতাকা (আইএসের) উড়ত।’

Soleimani

‘টার্গেট’ সোলেইমানি
সেনাবাহিনীতে যখন থেকে সোলেইমানির প্রভাব চোখে পড়তে থাকে, তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও সৌদি আরবের ‘টার্গেট’-এ পরিণত হন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও সৌদি মনে করে, লেবাননের হেজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাস, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ‘ফাতেমিয়ুন’ ও ‘জাইনাবিয়ুন’ এবং ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের পেছনে বড় শক্তি ইরান। আর ইরানকে এই ভূমিকায় এনেছেন সোলেইমানি। অর্থাৎ সোলেইমানির কারণেই সীমানার বাইরে সামরিক প্রভাব বেড়েছে ইরানের। এই প্রভাব ইসরায়েলের সীমান্তঘেঁষা দেশগুলোতে বেশি হওয়ায় সোলেইমানিকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথা ছিল তেলআবিবের। তারা মনে করতো, ‘ভবিষ্যৎ’ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সোলেইমানি ইরান-ইসরায়েলের ভৌগোলিক দূরত্ব ঘুচিয়ে ‘কৌশলগত’ দিক থেকে কাছাকাছি করে ফেলেছেন।

আর ইরানকে এভাবে ‘শত্রুর চোখে চোখ রেখে লড়াই’র সাহসী ভূমিকায় নিয়ে যাওয়ায় গত ২০ বছরে বহুবার হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছেন সোলেইমানি। কখনো ইরানের ভেতরের শক্তির সহায়তায়, কখনো ভাড়াটে খুনির সহায়তায় এ চেষ্টা চালিয়েছে শত্রুপক্ষ।

এক্ষেত্রে সোলেইমানি নিহত হয়েছেন বলেও গুজব ছড়ায় কয়েকবার। ২০০৬ সালে ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার পাশাপাশি তিনিও প্রাণ হারান বলে খবর ছড়ায়। এরপর ২০১২ সালে বাশার আল-আসাদের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর বোমা হামলায় সোলেইমানিও নিহত হন বলে দাবি করা হয়। ২০১৫ সালে আলেপ্পোয় বাশার আল-আসাদ বাহিনীর হয়ে যুদ্ধের সময় সোলেইমানি নিহত বা গুরুতর আহত হন বলেও খবর ছড়ায়। প্রতিবারই তেহরান জানিয়ে দেয়, এই জেনারেল বেঁচে আছেন।

গত বছরের আগস্টে সিরিয়ায় ইরানের বিপ্লবী গার্ডের কথিত ঘাঁটির ওপর দফায় দফায় বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। সেসময় তারা দাবি করে, ইরানের ওই বাহিনী ইসরায়েলে ‘খুনে ড্রোন হামলা’ চালানোর ছক কষছিল। হামলার পর ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাৎস সরাসরিই বলে দেন, সোলেইমানিকে ‘নির্মূল’ করতে কাজ করছে ইসরায়েল।

সবশেষ গত অক্টোবরে তেহরান জানায়, সোলেইমানিকে হত্যা করতে সৌদি ও ইসরায়েলের একটি যৌথ চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিয়েছে তারা। কিন্তু শেষতক সোলেইমানিকে প্রাণ দিতেই হলো।

তবে অন্যতম আস্থাভাজন জেনারেলের ‘শাহাদাত’-এ শোকাহত ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনী হুংকার দিয়ে বলেছেন, ‘অপরাধীদের কঠোর মাশুল গুনতে হবে’।

এইচএ/এমএস/এমকেএইচ

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।