মূল সমস্যা ক্যারিয়ার প্লানিং
‘সেলস্ আমাকে দিয়ে হবে না! আমার ডেস্ক জব চাই!’- একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র মার্কেটিংয়ে এমবিএ শেষ করা একজন চাকরিপ্রার্থী এমনটি বলছিলেন। আমার প্রশ্ন ছিল, ‘তাহলে কেন মার্কেটিংয়ে এমবিএ করলেন?’ উত্তরটা তেমন গ্রহণযোগ্য ছিলো না বলে উল্লেখ করলাম না। তবে একটি কাল্পনিক এবং সংগৃহীত গল্প দিয়ে শুরু করা যাক-
‘মামুন সাহেব। অনেক কষ্টে বাবার ভিটে-বাড়ি বিক্রি করে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করে আর তার দেখা নেই। স্কুল এবং কলেজে আমরা সবাই তাকে বিভিন্ন নামে ডাকতাম। অনেক সময় বন্ধুরা তার নামের ‘ন’ বাদ দিয়ে ‘মামু’ নামেই ডাকতো। এতে তার কোন ক্ষোভ ছিল না। প্রচণ্ড বাচাল স্বভাবের এই ছেলেটির সঙ্গে অনেক দিন যোগাযোগ না থাকায় খুব খারাপই লাগছিল।
হঠাৎ উঁচু অঙ্কের বেতন, ঝলমলে স্যুট-টাই পরা, ল্যাপটপ-আইফোন-৬এ কানেক্টিভিটি-তে বলীয়ান হয়ে স্মার্ট আর অপ্রতিরোধ্য ‘মামুন সাহেব’ হয়ে উঠলেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উঠতি চাকরিপ্রার্থীদের আইকন। মামুন সাহেবের নতুন নাম হল ‘সেলস এক্সিকিউটিভ’। সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলেন। পুরনো কোম্পানি ছেড়ে নতুন কোম্পানিতে যোগ দিলেন ‘সেলস্ ম্যানেজার’ হিসেবে। নতুন ফ্ল্যাট হল। বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা বা টার্গেট পূরণ করতে পারায় কোম্পানি খুশি হয়ে বখশিস দিল আস্ত একটা নতুন চার চাকার গাড়ি। পাড়া-প্রতিবেশীরা তাদের ছেলেমেয়েদের বলতে শুরু করলেন- ‘ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না হতে পারলে ক্ষতি নেই, মামুন সাহেবের মত হও।’ সাফল্যে ঝকমক করে উঠলো মামুন সাহেবের আংটি।
ক্রমে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়লো। নতুন নতুন কোম্পানি এলো। আরও অনেক অনেক মামুন সাহেবরা নেমে পড়লেন আলাদা আলাদা ব্র্যান্ডের একই পণ্য বিক্রি করতে। কী কী পণ্য? স্যানিটারি ন্যাপকিন, বিমা, জীবনদায়ী ওষুধ থেকে মোবাইল সংযোগ, আলপিন টু এলিফ্যান্ট। আরও বেশি বিক্রি করতে হবে, আরও কঠিন ধার্য হলো লক্ষ্যমাত্রা। মারাত্মক ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মামুন সাহেব। দেখা হলেই বলেন, ‘মরার সময় কই?’
আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে ক্যারিয়ার প্লানিং। বাবা বলেছেন তাই ডাক্তার হতে হবে, ইঞ্জিনিয়ার হলেও চলবে! অদ্ভুত বিষয়, আমি হতে চাই মিউজিশিয়ান, বিউটিশিয়ান, পলিটিশিয়ান, ফটোগ্রাফার, অভিনেতা, অভিনেত্রী অথবা কোন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির হেড অব সেলস্! বাবাকে বলার পর উত্তরটা স্বভাবতই সুখকর হবার কথা নয়। অনেক কষ্টে যখন বাবাকে ‘থ্রি ইডিয়টস্’ দেখানোর চেষ্টায় সফল হওয়া গেল এবং মুভির শেষ পর্যায়ে এসে বাবা বললেন, ‘এরা আসলেই ‘ইডিয়টস্’। তখন ভাষা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।
‘জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে’ এমন ডায়ালগ বুদ্ধি হবার পর থেকে শোনেননি এমন ব্যক্তির সংখ্যা খুবই কম। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ কোনটি? তাকি নির্ধারণ করা হয় তার পরিবারের ইচ্ছার উপর? নাকি ঐ ব্যক্তির কোনো ইচ্ছার প্রাধান্য রয়েছে?
কোনো পেশাকেই ছোট করে দেখার জন্য এই লেখা নয় বরং আমাদের আগ্রহটাকে একটু প্রাধান্য দিয়ে এবং সঠিক গাইডেন্সের মাধ্যমে সফলতার পথ খুঁজে দেওয়ার অনুরোধের জন্যই আমার এই ছোট্ট প্রয়াস।
যে ছেলেটি অথবা মেয়েটি ‘ব্যবসায় বিষয়ে’ পড়াশোনা করতে চাচ্ছে তাকে দিন না সেদিকে এগুতে। যে পেশায় সে আগ্রহ প্রকাশ করছে, দিন না তাকে তার মত করে সেই পেশায় এগিয়ে যেতে। দেখবেন, সে অবশ্যই ভালো করবে।
আমার বিশ্বাস এই লেখাটি আমাদের অভিভাবক মহলে বিশেষ সমালোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়াবে। তথাপি একজন ক্যারিয়ারিস্ট হিসেবে আমার অনুরোধ করার প্রয়োজন বলে আমি অনুরোধ করলাম। আশাকরি অভিভাবক মহল বিয়ষটি ভেবে দেখবেন।
বিল গেটস একবার মজা করে বলেছিলেন, ‘স্কুলে তোমার শিক্ষককে যদি খিটমিটে মনে হয়, কর্মক্ষেত্রে বসের সঙ্গে দেখা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করো!’
প্রতিদিন যে শব্দগুলোর সাথে আমরা পরিচিত তা হলো- ‘ডেডলাইন’, ‘প্রফিট’, ‘পারফরম্যান্স’, ‘উপস্থিতি’ ইত্যাদি। আর এই শব্দগুলো আসে- ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের (বস) মুখ থেকে। ‘বসভীতি’ আনতে হবে! এটি একটি কমন সাইকোলজি প্রচলিত বসদের! কর্মীদের কোনো কাজেই খুশি হওয়া যাবে না অথবা খুশির বহিঃপ্রকাশ ঘটানো যাবে না!
মোদ্দাকথা, একজন গম্ভীর বা রাশভারী কণ্ঠস্বর, বয়োজ্যোষ্ঠ ব্যক্তিই হবেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ (বস)! এমন বাসনা মালিকগণের! আশা করছি, আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন না। এ মত যারা এখনও পোষণ করে আছেন তাদের কাছে অনুরোধ, দয়া করে পরিবর্তনের ধারায় আসুন। সবকিছু পাল্টে গেছে। আসুন নিজেকেও পাল্টে ফেলি।
লেখক: ব্যবস্থাপক, এইচআর অ্যান্ড অ্যাডমিন, আকিজ গ্রুপ।
এসইউ/পিআর