পর্যটক বরণে প্রস্তুত পাহাড়ের রাণী খাগড়াছড়ি
বাংলাদেশের এক-দশমাংশ রূপময় ভূ-খণ্ড পার্বত্য চট্টগ্রাম। মহান সৃষ্টিকর্তা আপনমনে অপরূপ সাজে সাজানো পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ঢেউ খেলানো সৌন্দর্য্য, পাহাড়ি ঝর্ণারাজি দেশ-বিদেশের অনেক আকর্ষণীয় স্থানকেও হার মানাতে পারে। পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির চারদিক ঢেউতোলা সবুজের উঁচু পাহাড়ের দেয়াল। মাঝে মাঝে ব্যস্ত ছোট ছোট শহর ও শহরের প্রবেশ পথের দু’পাশে সবুজের বাঁকে-বাঁকে উঁচু-নিচু সর্পিল রাস্তা। অনেক পর্যটকই খাগড়াছড়ি শহরকে ছবিতে দেখা নেপালের কাঠমুন্ডু শহরের সাথে তুলনা করে থাকেন।
পাহাড়ের প্রকৃতি প্রতি ঋতুতেই রং বদলায়। বর্ষাকালে সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা ও রাতে বসে নানান রঙের মেলা। পাহাড় ঘেরা চাঁদনী রাতে এখানকার দৃশ্যপটে ভিন্নমাত্রা এনে দেয়। এই পাহাড়ের চূঁড়ায় বসে দূর পাহাড়ের বুক চিরে সকালের সূর্যোদয় আর সন্ধ্যায় সব আলোকে ম্লান করে সূর্যাস্তের দৃশ্য সত্যিই অপরূপ। নীল আকাশের সাদা মেঘ, সবুজ পাহাড়ের বাঁকে-বাঁকে মেঘের ভেলা, চেঙ্গী নদীর লাল মাটির ঘোলা পানির টানে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে কোনো দ্বিধা থাকেনা।
আবহমান বাংলার সবুজ প্রকৃতির অপরূপ বৈচিত্রের নৈসর্গিক লীলাভূমি খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বকোণে এর অবস্থান। বাংলার সুন্দরীকন্যা খ্যাত এই খাগড়াছড়ির উঁচু নিচু অসংখ্য পাহাড় আর পাহাড়ের বুকে নাম না জানা হাজারো গাছের সবুজ পাতায় সজ্জিত পাহাড়কে মনে হয় যেন সবুজের অভয়ারণ্য। উঁচু-নিচু ঢেউ তোলা সবুজ পাহাড়ের বুকচিরে কালো পিচের সর্পিল রাস্তা আর পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য যে কোনো পর্যটকের মন কাড়বে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। মাঝখানে সমতল ভূমি আর চারদিকে ঢেউ তোলা সুউচ্চ পাহাড়, দিগন্ত ছোঁয়া সবুজের সমারোহ, শীতে ফোঁটা চেঙ্গী নদী তীরের কাঁশফুল ও চন্দ্র সূর্যের রুপালী স্পর্শ, নদী, হ্রদ,পাহাড়ি ঝর্ণা সবাইকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আর এখানে এলে যা যা দেখবেন।
দীঘিনালার তৈদুছড়া, খাগড়াছড়ি আলুটিলার রহস্যময় সুরঙ্গ, জেলা পরিষদ পার্ক, মাটিরাঙ্গার রিছাং ঝর্ণা, পানছড়ির শান্তিপুর অরণ্যকুটির, মাটিরাঙ্গার শতবর্ষী বটগাছ আর মাটিরাঙ্গার জলপাহাড়। পর্যটকদের বরণে পাহাড়ের রাণী খ্যাত খাগড়াছড়ির পর্যটন স্পটগুলো প্রস্তুত। খাগড়াছড়ির ঈদ মানেই উৎসব। ঈদ মানেই বাড়তি আনন্দ। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই সারাদেশের মানুষের সঙ্গে উৎসবে মেতে উঠবে পাহাড়ের মানুষ। পাহাড়ের মানুষের উৎসবে বাড়তি আনন্দ দিতে প্রস্তুত স্থানীয় পর্যটন কেন্দ্রগুলোও। আয়োজনের যেন কোনো কমতি নেই।
আলুটিলার রহস্যময় সুরঙ্গ :
গা ছমছম করা অনভূতি নিয়ে পাহাড়ি সুরঙ্গ পথ বেঁয়ে পাতালে নামা কল্পনার হলেও আলুটিলার সুরঙ্গ কল্পনা নয় বরং বাস্তব। পাহাড়ের পিচ্ছিল পথ বেঁয়ে সুরঙ্গ‘র মুখ পর্যন্ত যেতে দর্শনার্থীদের এক সময় খুব কষ্ট হলেও এখন জেলা পরিষদের অর্থায়নে সেখানে পাকা সিঁড়ি করে দেয়া হয়েছে। পাহাড়ের চূঁড়া থেকে ২৬৬টি সিঁড়ি বেঁয়ে নীচে নামলেই সেই স্বপ্নীল সুরঙ্গমুখ। আলুটিলা সুরঙ্গের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮২ ফুট। ভূতুরে অন্ধকার এ সুরঙ্গে আগুনের মশাল নিয়ে ঢুকতে হয় কিছুটা সাহসের সঙ্গেই। সুরঙ্গের ভেতরে প্রবেশ করলে ভেঁসে উঠে এক অপরূপ প্রতিচ্ছবি। ভেতরে হাজার হজার বাঁদুর ঝুলে থাকার দৃশ্যও চোখে পড়ার মতো।
অনবদ্য রহস্যের উৎস প্রাকৃতিক এ সুরঙ্গের ভেতরটা দেখলে অবিশ্বাস্য বিস্ময়ে হতবাক হতে হবে যে কাউকেই। মনে হয় যেন পাহাড় কেটে কয়েক হাজার কারিগর মিলে নিখুঁতভাবে এ গুহাটি তৈরি করেছে। এ গুহায় প্রবেশ করে অন্যপ্রান্ত দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতায় আপনিও হতে পারবেন দু:সাহসিক এক অভিযাত্রী।
রিছাং ঝর্ণা :
আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র ও রহস্যময় গুহা থেকে কিছুটা দূরেই রয়েছে রিছাং নামক পাহাড়ি ঝর্ণা। শিরশির ছন্দে হিম শীতল ঝরণার বহমান স্বচ্ছ পানি যে কাউকেই কাছে টানবে খুব সহজেই। মূল সড়ক থেকে কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে স্বপ্নের রিছাং ঝর্নায়। এখানে আগত পর্যটকদের সবিধার্থে মাটিরাঙ্গা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রবেশ মুখে একটি গেইট নির্মাণসহ পর্যটকদের জন্য সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে বেশ কটি গোল ঘর। নিরাপত্তার জন্য বসানো হয়েছে পুলিশ পাহারাও। পর্যটকদের সুবিধার্থে সেখানে বেশকিছু উন্নয়ন প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়েছে। দেখে আসতে পারেন সেই মনোরম ঝর্ণাটিও।
দেবতা পুকুর :
খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি সড়কের কোল ঘেষে মাইসছড়ি এলাকার নুনছড়ি মৌজার আলুটিলা পর্বতশ্রেণি হতে সৃষ্ট ছোট্ট নদী নুনছড়ি। নুনছড়ির সমতল ভূমি হতে প্রায় সাত’শ ফুট উপরে পাহাড়ের চূঁড়ায় দেবতা পুকুর রূপকথার দেবতার আর্শিবাদের মতোই সলিল বারির স্রাবোতহীন সঞ্চার। পাঁচ একর আয়তনের এ পুকুরটির স্বচ্ছ জলরাশির মনভোলা প্রশান্তি মূহুর্তের মধ্যে পর্যটকদের উদাসীন করে তুলতে পারে। পুকুরের চারিদিকে ঘন সবুজ বনরাজি যেন সৌন্দর্যের দেবতা বর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কথিত আছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের জলতৃষ্ণা নিবারণের জন্য স্বয়ং জলদেবতা এ পুকুর খনন করেছেন। পুকুরের পানিকে স্থানীয় পাহাড়িরা দেবতার আর্শীবাদ বলে মনে করে। প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অজস্র নারী-পুরুষ পূন্য লাভের আশায় দেবতা পুকুর দর্শনে আসেন।
জলপাহাড় :
মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদরের একমাত্র বিনোদন পার্ক জলপাহাড় হতে পারে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। ঘরের কাছে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন জলপাহাড়। নাগরদোলা, ময়ুরপঙ্খী নৌকা, ট্রেন হয়ে উঠবে আপনার বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। জলপাহাড়ের সুবিশাল লেক আপনাকে বাড়তি আনন্দ দিবে নি:সন্দেহে। নিরপাত্তা বেষ্টনির মধ্যে এতো বড় সুযোগ শহরের পাশে আর কোথাও নেই। ঈদকে ঘিরে অপরুপ সাজে সেজেছে জলপাহাড়।
হেরিটেজ পার্ক :
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সর্পিল প্রবাহ নিয়ে বয়ে যাওয়া চেঙ্গী নদীর কোলে জেলা আনসার ও ভিডিপি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উঁচু পাহাড়ে অবস্থিত হেরিটেজ পার্ক ইতোমধ্যে পর্যটন কেন্দ্রের তালিকায় নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। পর্যটন পিপাসুদের কাছে হেরিটেজ পার্ক হয়ে উঠেছে নতুন ঠিকানা। পর্যটন মোটেলের বিপরীতে সৌন্দর্য্য মন্ডিত ও নান্দনিক হেরিটেজ পার্কটির অবস্থান। এখানকার প্রকৃতি যেন ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। নানা বয়সী মানুষের ভিড়ে সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যায় এখানে বসে রঙের মেলা। আর পাহাড় ঘেরা প্রকৃতিতে বসে চাঁদনী রাতের দৃশ্যপটে এনে দেয় ভিন্ন মাত্রা। ১০ একর ভূমিতে অবস্থিত হেরিটেজ পার্কে সংবাদকর্মীদের জন্য স্থাপন করা হয়েছে ‘মিডিয়া সেন্টার’। হেরিটেজ পার্কের পেভিলিয়নে বসে চেঙ্গী নদী ও আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রের সৌন্দর্য্য যে কারোরই মন ছুঁয়ে যাবে।
ভগবান টিলা :
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলা থেকে সোজা উত্তরে ভারতের সীমান্তবর্তী ভগবান টিলা। জেলা সদর থেকে উত্তর পশ্চিমে এর কৌণিক দূরত্ব আনুমানিক ৮৫ কিলোমিটার। সবুজের বুক চিরে আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে এগোলে পাহাড়ের অপরুপ নৈস্বর্গের অপলক নেত্র ততই বিস্ময় বিহবল হবেই। এ টিলা যেন বিধাতার নিজ হাতে গড়া পর্বত রূপসী। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় এক হাজার ছয়’শ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এ টিলা সম্পর্কে স্থানীয়দের ধারণা, এ টিলার উপরে দাঁড়িয়ে ডাক দিলে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও ওই ডাক শুনতে পান। আর এ কারণেই প্রাচীন লোকজন এ টিলার নামকরণ করেছিলেন ভগবান টিলা। সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি’র একটি আউট পোস্টও রয়েছে এখানে। বিজিবি‘র সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে দাঁড়ালে মনে হয় আপন অস্তিত্ব শূন্যে হারিয়ে গেছে। সবুজে ঘেরা বাঁশের ঝোপ, নাম না জানা নানান ধরনের পার্থিব ডাক আর পাহাড়ের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝর্ণার কলকল জীবন্ত শব্দ সবকিছু মিলিয়ে হারিয়ে যাওয়ার এক অনন্য স্বপ্নপূরী ‘ভগবান টিলা’।
রামগড় চা বাগান:
জেলার রামগড়ে সীমান্ত ঘেঁষে খাগড়াছড়ি জেলায় প্রবশের সম্মুখভাগে খাগড়াছড়ি-ফেনী আঞ্চলিক মহাসড়কের সড়কের দু’ধারে গড়ে উঠেছে বিশাল চা বাগান। যা খাগড়াছড়ির পর্যটন শিল্পকে করেছে স্বয়ং সম্পূর্ণ। খাগড়াছড়িতে আসা ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের স্বাগত জানাতে এটি সদা প্রস্তুত। বিশাল এলাকা জুড়ে এই চা বাগানে আসলে পর্যটকরা বুঝতেই পারবে না তারা চা বাগানের ভূমি খ্যাত সিলেট আছেন না পাহাড়ি কন্যা খাগড়াছড়িতে।
রামগড় লেক:
খাগড়াছড়ি জেলা সদর হতে ৫০ কি.মি. উত্তর-পশ্চিমে খাগড়াছড়ির প্রবেশদ্বার রামগড় উপজেলা। উপজেলা পরিষদের সম্মুখভাগে ইংরেজি অর ডব্লিউ-এর অনুরূপ প্রায় ২৫০ মিটার লম্বা একটি হ্রদ। এতে আনন্দ ভ্রমণের জন্য রয়েছে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি প্রমোদ তরী। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াদুদ ভুইয়ার পরিকল্পনায় গড়ে তোলা রামগড় পর্যটন লেকটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং দৃষ্টিনন্দন। চারপাশ বাঁধানো লেকটি রেলিং ঘেরা এবং বাহারি সাজে সজ্জিত। লেকের উভয় পাশে যোগাযোগের জন্য মাঝখানে রয়েছে সুদৃশ্য ঝুলন্ত সেতু। লেকের চারপাশে রয়েছে সুন্দর বাগান, সবুজ ঘাস, আধুনিক লাইটিং, শান বাঁধানো সিঁড়ি। লেকের দুই তীরে রয়েছে মনোমুগ্ধকর উদ্যান। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ধরনের শোভাবর্ধনকারী ও ওষুধি-গাছপালা রয়েছে উদ্যানজুড়ে। এ উদ্যানে আগত দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য রয়েছে ১২টি শেড। লেকের ঠিক মধ্যখানে একটি ঝুলন্ত ব্রিজ। এ লেকটি হতে পারে আপনার ভ্রমণের জন্য এক অনন্য স্থান। সবমিলিয়ে রাঙ্গামাটির আদলে নির্মিত ঝুলন্ত ব্রিজ, বোটানিক্যাল গার্ডেন, কৃত্রিম লেক, দৃষ্টিনন্দিত স্মৃতিস্তম্ভ, শহীদ মিনার সব কিছু মিলিয়ে হঠাৎ করে রামগড়কে ইউরোপের কোনো একটি সিটির মতো মনে হয়।
মানিকছড়ি রাজবাড়ী :
খাগড়াছড়ি-ঢাকা সড়কের খাগড়াছড়ি জেলার প্রবেশমুখ মানিকছড়ি উপজেলা সদরে রয়েছে খাগড়াছড়ির অন্যতম দশর্নীয় স্থান মানিকছড়ি রাজবাড়ি। রাজবাড়িতে রয়েছে মংসার্কেল চীফ (মংরাজা)‘র রাজত্বকালীন স্থাপত্য। রাজার সিংহাসন, মূল্যবান অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রত্নতাত্ত্বিক অনেক স্মৃতি বিজড়িত এই রাজবাড়ী। নানাদিক থেকে দর্শনীয় হলেও মংরাজার উত্তারাধিকার সূত্র নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ ও জটিলতার কারণে রাজবাড়িটি আজ চরম অবহেলিত। আপনার ভ্রমণ পিপাসা মিটাতে পারে মানিকছড়ির রাজবাড়ি।
শতবর্ষী বটগাছ :
মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদরের খুব কাছাকাছি আলুটিলা-বটতলী এলাকায় এ প্রাচীন শতায়ু বর্ষী বটবৃক্ষটি শুধু ইতিহাসের সাক্ষি নয় এ যেন দর্শনীয় আশ্চার্য্যের কোনো উপাদান। পাঁচ একরের অধিক ভূমির উপরে এ গাছটি হাজারো পর্যটকের কাছে দারুণ আকর্ষনীয়। মূল বটগাছটি থেকে নেমে আসা প্রতিটি ডালপালা মাটিতে মিশে কালের পরিক্রমায় এক একটি নতুন বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। ঢালাপালা থেকে সৃষ্ট প্রতিটি বটগাছ তার মূলগাছের সঙ্গে সন্তানের মতো জড়িয়ে আছে আপন মমতায়।
কালের বিবর্তণে সবাই শুনেছে বটগাছকে ঘিরে নানা কাহিনী। কখনো তা আনন্দের আর কখনো ভয়ের, আবার কখনো তা ঘুমপারানি পিসি-মাসি, কখনো তা রোগমুক্তির প্রতীক হিসেবে। আর এসব কিছুই কল্পনা নির্ভর কোনো কাহিনী। কল্প-কাহিনী যা-ই হোক শতবর্ষী এই বটগাছকে ঘিরে সময়ের ব্যবধানে মাটিরাঙ্গা হয়ে উঠতে শুরু করেছে সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে। মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এ ঐতিহ্যবাহী বটবৃক্ষের নামানুসারেই নামকরণ করা হয়েছে বটতলী বাজার। ইতোমধ্যেই বটগাছটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি স্কুল, একটি মাদ্রাসা, একটি ছোট বাজার।
তৈদুছড়া ঝর্ণা :
খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলায় সবুজ পাহাড় আর বুনো জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত নয়নাভিরাম ঝরনা দুটির নাম তৈদুছড়া ঝরনা। ত্রিপুরা ভাষায় ‘তৈদু’ হল ‘পানির দরজা’ আর ‘ছড়া’ মানে ‘ঝর্না’। এ দুইয়ে মিলে দীঘিনালার ‘তৈদুছড়া ঝর্ণা’। অসাধারণ সৌন্দর্য আর প্রাকৃতিক বৈচিত্রতা তৈদুছড়াকে এনে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। বিধাতা যেন তার মাহিমান্বিত নিদর্শন ছড়িয়ে দিয়েছেন গহীণ অরণ্যে। যা একবার দেখলে বার বার ছুটে আসতে চাইবেন। আর এবারের ঈদে দীঘিনালার দুর্গম পাহাড়ের ‘তৈদুছড়া ঝর্ণা’ হতে পারে আপনার বিনোদনের বড় ক্ষেত্র।
পাহাড়ের সৌন্দর্য্যকে কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে তৈদুছড়া। আশ্চর্যরকম আর অনিন্দ্য সুন্দর এক জলপ্রপাত। সরকারের সুদৃষ্টি, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা আর পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো গেলে প্রচারের অন্তরালে থাকা তৈদুছড়া হয়ে উঠতে পারে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন চাবি। যা থেকে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে বহুগুন। দেশ-বিদেশর পর্যটকদের বিচরণভূমিতেও পরিণত হতে পারে এ তৈদুছড়া।
খাগড়াছড়ি জেলা শহর থেকে মোটরসাইকেল, সিএনজি বা চাঁদের গাড়িতে রওয়ানা হয়ে দিঘীনালা পৌঁছে ৯ কিলোমিটার দূরে নয় মাইল নামক স্থান থেকে যেতে হবে সীমানা পাড়া। সেখান থেকে পায়ে হাঁটা পথ শুরু। মাত্র এক ঘণ্টা হাঁটার পরই পৌছে যাবেন রূপবতী তৈদু ঝর্নাতে। এছাড়াও দীঘিনালা সদর থেকে দুই কি: মি: সামনে জামতলি দিয়ে মায়াফাপাড়া এলাকা হয়ে যাওয়া যাবে তৈদুছড়া ঝরনায়। এক্ষেত্রে দিঘীনালায় অবশ্য স্থানীয় গাইড নিতে হবে। যে আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে তৈদুছড়া।
দীঘিনালায় শিবছড়ি পাহাড় :
শিবছড়ি পাহাড়। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৬ কি.মি. দূরে দেওয়ানপাড়া এলাকায় অবস্থিত ‘শিবছড়ি পাহাড়’। পাহাড়ি ছড়া, নালা আর গভীর অরণ্য পেরিয়ে বোয়ালখালী নদীর পাশ ঘেঁষে সুউচ্চ পাহাড়ি ঝর্ণা ও সৌন্দর্য্যমন্ডিত বিভিন্ন পাথরের রূপ পর্যটকদের আকৃষ্ট করবেই। আপনার ভ্রমণ পিপাসা মিটাতে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন দীঘিনালার ‘শিবছড়ি পাহাড়’ থেকে।
সবমিলিয়ে খাগড়াছড়ির সৌর্ন্দয্য আপনাকে হাত ছানি দিয়ে ঢাকছে। প্রাকৃতিক সৌর্ন্দয্যকে কাজে লাগাতে পারলে খাগড়াছড়ি হতে পারে দেশের পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেই সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক চেহারা পাল্টে যাবে। প্রয়োজন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে আস্থা-বিশ্বাস। অতীতের সব ভ্রান্তি ভূলে পার্বত্য জনপদে পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে সকল নাগরিক এগিয়ে চলুক সামনের দিকে। পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাস স্থাপনের মাঝে রয়েছে এ অঞ্চলের প্রকৃত শান্তি ও সমৃদ্ধি। আমরা তাকিয়ে আছি সম্ভাবনাময় সমৃদ্ধি আর স্বপ্নমাখা আগামীর পানে।
কিভাবে আসবেন :
ঢাকা হতে খাগড়াছড়ির দূরত্ব ৩১৬ কি.মি. ও চট্টগ্রাম হতে ১০৯ কি.মি.। রাজধানী শহর ঢাকার কমলাপুর, সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, কলাবাগান থেকে সরাসরি বাস সার্ভিস রয়েছে খাগড়াছড়িতে। সেন্টমার্টিন (এসি বাস), এস আলম, সৌদিয়া, শান্তি পরিবহন, ইকোনো, ঈগল ও শ্যামলী পরিবহনের বাসযোগে খাগড়াছড়ি আসতে পারেন আপনি। আর এতে আপনাকে জনপ্রতি ৫২০-৫৫০ টাকা ভাড়া গুনতে হবে। আর এসি বাসে ভাড়া লাগবে ৮৫০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে আসতে হলে আপনাকে অক্সিজেন অথবা কদমতলী বিআরটিসি বাস টার্মিনাল থেকে খাগড়াছড়ি অভিমুখী গাড়িতে উঠতে হবে। অক্সিজেন থেকে রয়েছে শান্তি পরিবহন অথবা লোকাল বাস আর কদমতলী থেকে বিআরটিসি রিজার্ভ বাস। চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি আসতে জনপ্রতি ১৮০-২২০ টাকা ভাড়া গুনতে হবে।
কোথায় থাকবেন ?
আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রের খুব কাছাকাছি পাহাড়ের চূড়ায় ইমাং রির্সোস অ্যান্ড নেচারাল রেস্টুরেন্ট ডবল কক্ষ নন এসি ১২০০ টাকা, সিঙ্গেল নন এসি ১০০০ টাকা, ডবল এসি রুম ১৮০০ টাকা। শহরের প্রবেশমূখে চেঙ্গী নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত পর্যটন মোটেলের ডবল রুম নন এসি ১০৫০ টাকা, ডবল এসি রুম ১৫০০ টাকা, ভিআইপি স্যুইট ২৫০০ টাকা। এছাড়াও রয়েছে জেলা সদরের মিলনপুরে হোটেল গাইরিঙ ও ক্যান্টমেন্ট এলাকায় হোটেল ইকোছড়ি ইন। সেখানেও থাকা-খাওয়ার সুযোগ-সুবিধা রয়েছে হাতের নাগালেই। খাগড়াছড়ি বাজার এলাকার হোটেল আল-মাসুদ, হোটেল লবিয়ত, হোটেল ফোর স্টারসহ অনেকগুলো হোটেলে থাকতে পারবেন অনেক কম মূল্যে।
এমএএস/এমএস