শামস আল মমীন এর পাঁচটি কবিতা
ইমিগ্র্যান্ট
তুমি বসতেই পারো, পা দুলিয়ে, আরাম চেয়ারে।
মেঘ ছুঁয়ে ছুঁয়ে পার হতে পারো প্যাসিফিক
অথবা আটলান্টিক। চাঁদের দেশের
মতো স্বপ্নে দেখা এই দেশ।
আকাশে ওঠার সিঁড়ি আর
পৃথিবীর মানচিত্র দেখতে দেখতে দু’একটা বাল্যস্মৃতি,
ছাইমাখা সরপুঁটি, মিছিলের অগ্নিপথ মাঝে মাঝে
স্বপ্নময় হয়ে ওঠে
এখানে রহস্য আছে
ঘর ভাঙবার ভয় আছে
জোহরের পর নেশার আসর আছে
টেবিলের ফুলদানি, সুগন্ধ সাবান, আর গাড়ির বনেটে
লক্ষ টাকার গন্ধ আছে।
সংসারে নৃত্য করে নিত্য
নরোম চাঁদের আলো। তুমি
শুনবে না ফেরিঅলার মচমচা ডাক, পাখিদের
কিচির মিচির কিম্বা বলের পিছনে ধাবমান বালকের
একরোখা দৌড়।
ফ্রেমে বাঁধা নীরব ছবির মতো বড়ো
হবে ছেলেমেয়ে। প্রতিবেশির অসহ্য প্রীতি
ওদের কোমল মুখে ছায়া হয়ে থাকে
এদেশ সোনার, অফুরন্ত ফসলের এবং সম্ভাবনার;
কিন্তু এর কতটা তোমার!
চুপ থাকি
সুরগুলো
ভেসে আসে..
আমি চুপচাপ থাকি
শোনার ইচ্ছায়।
যৌবনে যাদের কণ্ঠ
ইলেকট্রিক গিটারের মতো টানটান ছিল
তারাও নির্জনে..
কানে কানে কথা কয় আজ।
অনেকেই হাসতে হাসতে থেমে গেছে
আমি চুপ থাকি
শেষটুকু
শোনার ইচ্ছায়।
ভালোবাসার ছাইভস্ম
হঠাৎ আমার এক বন্ধু, যাকে বন্ধুই জেনেছি এতকাল,
গাল ভরা গালি দিয়ে টেলিফোন রেখে দিল। আগে
পিছে কিছু না ভেবেই আমি
নিজেকে গুটিয়ে নেই... এবং এটাই
স্বাভাবিক। ভরা শ্রাবণেও বৃষ্টি আর
পড়ে না। ফায়ার ইঞ্জিনগুলোর ব্যস্ত ছোটাছুটি শহরের পূর্ব
থেকে পশ্চিমে যেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোকজন সিগারেট
খাচ্ছে আর দেখছে প্রতিবেশির পুড়ে যাওয়া ঘর;
মানুষে মানুষে সম্পর্ক নষ্টের এটা কোন যুৎসই সময় নয়।
ভেবে দেখলাম,
আমি ভুল মেয়েকে ভালোবেসে
ভুল জায়গায়
ভুল সময়ে এসেছি; কিন্তু কেউ যদি
বলে এটা আমি অন্য ভাবেও করতে পারতাম, আমার কি
কিছু আসে যায় ? যদিও আবার ফিরে এসেছি এখানে যেন
কোথাও আমার যাওয়ার জায়গা নেই যেন আমার সমস্ত
ভালোবাসা লোহা লক্করের স্তুপে চাপা পড়ে আছে। আর আমি,
ঘন ধোঁয়া আর পোড়া গন্ধ
ঠেলে মই বেয়ে
আমারই ভালোবাসার ছাইভস্ম খুঁজি... যেন
ওগুলো আমার একমাত্র বাঁচার সম্বল।
পিতা-পুত্র
খোকা,
আয় দেখি, বস
একটু পাশে বস
কোথা যাবি বিকালের এই ঝুরঝুরে হাওয়ায়
কেন সাথী হবি মৌন মেঘের মিছিলে
তার চেয়ে
আরও ক’টা পাতা ঝরা
আরও কিছুক্ষণ
চোখে চোখে থাক;
একটা চড়ুই.. কি আশায়
পাশে এসে বসে।
খোকা বলে,
যাই..
আমি বলি, বস..
আর একটু বস..
কালো মেঘগুলো সরে গেলে
পথের কুকুর সব চলে গেলে,
তারপর না হয়..
ওর চলে যাওয়া দেখি;
দেখতে দেখতে কি যে মায়া গাঢ় হয়
কি যে সুখ নড়ে ওঠে!
জলের আছাড় খাওয়া নরম মাটির মতো
আমিও ভাঙতে থাকি
আমিও ভাঙতে থাকি খুব
আমার ভেতরে।
চিকলি
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ- জ্যোতিন্দ্র মোহন বাগচী
(বদরগঞ্জে, যাদের সাথে বেড়ে উঠেছি সেই সব বন্ধুদের, যাদের ভালোবাসার শাসনে সিক্ত ছিলাম
সেইসব অগ্রজদের, আর যাদের সাথে সখ্য গড়ে তুলবার সুযোগ হয়নি সেইসব অনুজদের )
বাঁশ বাগানের মাথার উপর থেকে সরে গেলে চাঁদ
আমাদের ঘুম ভাঙে,
আস্তে আস্তে চিকলিও জেগে ওঠে, স্বাগত জানায়..
সুপ্রভাত বদরগঞ্জ
সুপ্রভাত হক সাহেব
সুপ্রভাত জিতেন দত্ত
কেমন আছেন চেয়ারম্যান সাহেব।
থৈ থৈ বুড়িগঙ্গায় যখন ঢেউগুলো খুব ক্ষ্যাপা
হঠাৎ চঞ্চল শীতলক্ষ্যা
যখন পদ্মা-মেঘনা গিলে খায় অভাগিনীর ভিটা
চিকলি তখন কাঁদে, খুব কাঁদে,
তারও ছিল কোমর বাঁকানো ঢেউ
ছিল ভাঙার সাহস
ভয়ে ভয়ে সারারাত জাগে ফেচকিপাড়া।
চিকলি আমার ছেলেবেলা চেনে
হাত থেকে খসে পড়া হারানো আধুলিটি চেনে
ছিপ ফেলে বসে থাকা হাছানের শূন্য খলুইয়ের
হাহাকার জানে;
চিকলি জানে হাঁটু জলে পার হওয়া যুবতীর শিহরণ।
শ্মশানে পড়ে থাকা হাঁড়গুলো
চিকলি চেনে;
আমার জামার হারানো বোতাম ভেসে গেছে কোন কূলে
চিকলি তা জানে,
চিকলি জানে ভালবেসে রাধা কেন কাঁদে; অথচ
তোমার আক্রোশে বেড়ে উঠি আমি..কি সন্ত্রস্ত বিপর্যস্ত;
ভাঙনের শব্দে মা মা বলে কতবার জাপটে ধরেছি ..
মা আমাকে বুকের গভীরে লুকিয়ে আমার মুখে লেপ্টে থাকা সব ভয়
গোসল জলের মতো মুছে দিয়েছেন।
তুমিও পাষাণ ছিলে খুব,
ভিলেনের মতো অট্টহাসিতে আবার দেখাতে ভাঙনের ভয়।
ভিষণ ক্ষুধার্ত, ভিষণ বুভুক্ষু ছিলে তুমি
যেন হাজার নদীর গভীরতা পেটে গিলে খাও
বিশাল বটের ছায়া, পুষ্প-বৃক্ষ, জ্যোৎস্নায় ঝলসে ওঠা
রমনীর সাধ-আহ্লাদ;
অসহায় দাঁড়িয়ে দেখেছি আমি
তোমার উদরে
নিঃশব্দে হারিয়ে যাওয়া আমার খেলার মাঠ
রঙিন মেলার মাঠ, কিন্তু
দিনে দিনে আরও ক্ষুধাতুর, আরও
হিংস্র হয়ে উদরে নিয়েছ লোহানীর বাস্তভিটা,
বারবনিতার ঘরবাড়ি, এমন কি
প্রহরীর মতো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা শিমুল গাছটা।
জানালায় চোখ রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নবনীতা..
এই বুঝি ভেসে যায়, শুভ দিন!
চিকলি, এখন তোমার গা ছুঁয়ে আছি ..
দেখোতো, আমাকে চিনতে পারো কি-না? আমি মমীন..
বহুকাল বিভূই-বিদেশে; শৈশবে তোমার বুকে
লাফিয়ে ঝাপিয়ে চোখ লাল করে ঘরে ফিরে গেছি কতদিন!
একদা তোমার ঢেউয়ে ছলকে ওঠা মাছগুলো
লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে কোমর দোলায় না আর,
প্রেমিকের ভিড় নেই বিকেল হাওয়ায়
অশীতিপর বৃদ্ধার মতো ক্লান্ত জল, কিন্তু
চিকলি, আমি কি
তোমার ধ্বংসযজ্ঞের জন্য পঞ্চায়েত ডেকে বিচার চাইবো?
আমিতো দেখেছি তোমার চোখের কোণে বেসামাল জল..
দেখে নিও, তুমি দেখে নিও,
মেঘ ভাঙা গর্জনে উড়ন্ত বিদ্যুতের সন্ত্রাস শেষে হয়তো আমিও
উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখে যাবো
থৈ থৈ জলে ভেসে গেছে তোমার শোকের ভেলা।
বাঁশ বাগানের মাথার উপর থেকে সরে গেলে চাঁদ
আমাদের ঘুম ভাঙে,
আস্তে আস্তে চিকলিও জেগে ওঠে,
স্বাগত জানায়..
সুপ্রভাত বদরগঞ্জ
ভাল থেকো মুন্সিপাড়া
ভাল থেকো থানাপাড়া
ভাল থেকো..
আমার চোখের পাতায় সারাক্ষণ টলমল ডাক্তারপাড়া।
* চিকলি একটি নদীর নাম
এইচআর/পিআর