সৌদি-ইরানের দ্বন্দ্ব যে কারণে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দেয়ার পর ইরান বলছে, বিভিন্ন বিদেশি শক্তি এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্যে হুমকির কারণ হয়ে উঠছে। ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন, এসব বিদেশি শক্তি সবসময় ‘দুঃখ-দুর্দশা’ বয়ে এনেছে এবং এখানে ‘অস্ত্র প্রতিযোগিতা’ তৈরি করা উচিত নয়।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় তেল উৎপাদন কোম্পারি অ্যারামকোর দুটি বৃহত্তম স্থাপনায় হামলার পর সৌদি আরবে মোতায়েন মার্কিন সেনার সংখ্যা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব উভয় দেশ হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করছে।
ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা দীর্ঘদিনের। কিন্তু গত বছর থেকে সেই উত্তেজনা অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর আন্তর্জাতিক ছয় পরাশক্তির সঙ্গে ইরানের স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে ট্রাম্প তেহরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ যার নেপথ্যে।
কিন্তু সবশেষ সৌদি আরবের আবকাইক তেলক্ষেত্র ও খুরাইস তেল শোধনাগারে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর উপসাগরীয় অঞ্চলে নতুন করে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সৌদি আরব বলছে, তারা যদি প্রমাণ পায় এই হামলার সঙ্গে ইরান জড়িত তাহলে তারা প্রতিশোধ নেবে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন শুক্রবার জানিয়েছে, সৌদি আরবের অনুরোধে তারা সেখানে আরও সেনা পাঠাবে। তবে এই সংখ্যা হাজার হাজার হবে না। যুক্তরাষ্ট্র মূলত সৌদি আরবের বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপর জোর দেবে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট রুহানি এর পর বলেছেন, বিদেশি শক্তি এ অঞ্চলে অতীতেও বিপর্যয় নিয়ে এসেছে এবং তিনি তাদেরকে এখান থেকে দূরে থাকতে বলেন। ইরানের রেভ্যুলেশনারি গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে।
এতো শত্রুতার কারণ
সৌদি আরব ও ইরান শক্তিশালী দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র। আঞ্চলিক আধিপত্য বজায় রাখতে তারা যুগের পর যুগ ধরে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। বেশ কয়েক দশক ধরে চলে আসা এই শত্রুতা আরো তীব্র হয়েছে আরও একটি কারণে। কেননা উভয়ই ইসলামী দেশ হলেও তাদের মধ্যে ‘ধর্মীয় পার্থক্য’ বিদ্যমান।
সৌদি আরব এবং ইরান ইসলাম ধর্মের মূল দুটি শাখার অনুসারী। ইরান হলো শিয়া মুসলিম বিশ্ব এবং অন্যদিকে সৌদি আরব সুন্নি মুসলিম জগতের শীর্ষ শক্তি হিসেবে বিবেচিত। ধর্মীয় এই বিভাজন মধ্যপ্রাচ্যের বাকি মানচিত্রেও দেখা যায়।
বাকি দেশগুলোর কোনটিতে হয়তো শিয়া আবার কোনটিতে সুন্নি অনুসারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের কেউ ইরানের সঙ্গে, আবার কেউ সৌদি আরবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ।
ঐতিহাসিকভাবেই সৌদি আরব - যেখানে ইসলামের জন্ম হয়েছে, তারা নিজেদেরকে মুসলিম বিশ্বের নেতা বলে দাবি করে। কিন্তু ১৯৭৯ সালে এই দাবিকে চ্যালেঞ্জ করে ইরানের ইসলামি বিপ্লব।
ওই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ওই অঞ্চলে নতুন এক ধরনের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। যা এক ধরনের বিপ্লবী মোল্লাতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইরানের বাইরেও এমন রাষ্ট্রের মডেল ছড়িয়ে দেয়া।
পরিস্থিতি কিভাবে এতো খারাপ হলো?
গত ১৫ বছরে একের পর এক নানা ঘটনার জেরে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে বিভেদ বাড়তে বাড়তে আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। ইরানের বিরোধী অন্যতম বৃহৎ শক্তি ছিলেন ইরাকের প্রেসিডেন্ট ও সুন্নি আরব নেতা সাদ্দাম হোসেন।
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত সামরিক অভিযানে তাকে ক্ষমতা থেকে হটানো হয়। কিন্তু এর ফলেই ইরানের সামনে থেকে বড় একটি সামরিক বাধা দূর হয়, খুলে যায় বাগদাদে শিয়া-প্রধান সরকার গঠনের পথ। শুধু তাই নয়, এরপর থেকে দেশটিতে ইরানের প্রভাব বেড়েই চলেছে।
এরপর ২০১১ সাল থেকে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শুরু হয় স্বৈরশাসনবিরোধী রাজনৈতিক অস্থিরতা। সরকারবিরোধী এসব আন্দোলন ‘আরব বসন্ত’ গোটা বিশ্বে পরিচিত। যার কারণে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের একনায়কদের ভিত নড়ে উঠলে ওই অঞ্চলের রাষ্ট্রকাঠামো অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।
টালমাটাল এই পরিস্থিতিকে সৌদি আরব ও ইরান নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে তাদের প্রভাব বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। বিশেষ করে সিরিয়া, বাহরাইন এবং ইয়েমেন। ফলে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস ও শত্রুতা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ইরানের প্রভাব বাড়ায় অস্বস্তিতে সৌদি
ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে শত্রুতা দিনে দিনে ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে, কারণ আঞ্চলিক নানা লড়াই-এ বিভিন্নভাবে ইরান জয়ী হচ্ছে। বিশেষ করে এটা ঘটেছে সিরিয়াতে।
সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরোধী বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে আসছিল সৌদি আরব। কিন্তু সিরিয়ার সরকারি বাহিনী রাশিয়া ও ইরানের সাহায্য নিয়ে তাদেরকে হটিয়ে দিতে সমর্থ হচ্ছে। তাই সৌদি আরব এখন ওই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান ইরানি প্রভাবের লাগাম টেনে ধরতে মরিয়া।
কিন্তু সৌদি যুবরাজ মূলত দেশটির প্রকৃত নেতা মোহাম্মদ বিন সালমানের সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে সেখানে আঞ্চলিক উত্তেজনা আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। বিন সালমান এখন প্রতিবেশী ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধ লিপ্ত। এই যুদ্ধের একটি উদ্দেশ্য সেখানে ইরানি প্রভাব প্রতিহত করা।
কিন্তু চার বছর পর মনে হচ্ছে, এই যুদ্ধ সৌদি আরবের জন্যে ব্যয়বহুল এক বাজিতে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের অনেক আইনপ্রণেতা ইয়েমেন সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। কেননা দেশটির মারাাত্মক এক সঙ্কটের মুখে পতিত।
তবে হুথিদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করার অভিযোগ অস্বীকার করেছে ইরান। কিন্তু জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেলের দেয়া কয়েকটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তেহরান হুথি বিদ্রোহীদেরকে অস্ত্র ও প্রযুক্তি দিয়ে বড় রকমের সাহায্য ও সমর্থন দিচ্ছে।
অন্যদিকে, লেবাননেও আছে ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র শিয়া মিলিশিয়া গ্রুপ হিজবুল্লাহ। যারা শক্তিশালী একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করছে সশস্ত্র যোদ্ধাদের বিশাল একটি বাহিনীকে।
অনেক পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেন, ২০১৭ সালে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি সৌদি আরবে গেলে তাকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য করেছিল সৌদি আরব। হারিরি পরে সৌদি আরব থেকে লেবাননে ফিরে গেছেন ঠিকই কিন্তু পদত্যাগের বিষয়টিকে তিনি স্থগিত করে রাখেন।
পেছনে ‘বাইরের শক্তির’ খেলাও আছে
বিবিসির বিশ্লেষক জনাথন মার্কাস বলছেন, এখানে বাইরের শক্তিগুলোরও খেলা আছে। সৌদি আরবকে সাহস যোগাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর তেহরানকে নিয়ন্ত্রণে সৌদি আরবকে সমর্থন দিচ্ছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের একটি বড় ভয় হচ্ছে, সিরিয়ায় ইরানপন্থী যোদ্ধারা জয়ী হতে থাকলে একসময় তারা তাদের সীমান্তের কাছে চলে আসতে পারে। ইরান ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ২০১৫ সালে যে পরমাণু চুক্তি সই হয়েছিল ইসরায়েল ও সৌদি আরব তার কট্টর বিরোধী ছিল।
তাদের কথা ছিল, এরকম একটি চুক্তির মাধ্যমে পারমাণবিক বোমা বানানোর আকাঙ্ক্ষা থেকে ইরানকে বিরত রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই মধ্যপ্রাচ্যে বড় মিত্র সৌদি-ইসরায়েলের মন যোগাতে বোধহয় ক্ষমতায় আসার পরপরই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চুক্তিটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন।
কারা তাদের আঞ্চলিক মিত্র?
মোটা দাগে বলতে গেলে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র শিয়া-সুন্নি বিভাজনে বিভক্ত। সৌদি শিবিরে আছে উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য সুন্নি দেশগুলো। তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিসর এবং জর্ডান।
অন্যদিকে ইরানের সঙ্গে আছে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ সশস্ত্র গোষ্ঠী। অন্যদিকে ইরাকের শিয়া নিয়ন্ত্রিত সরকারও ইরানের মিত্র। তারা আবার ওয়াশিংটনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে যুদ্ধে তারাও যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল।
সৌদি-ইরান শত্রুতার প্রভাব
মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলে এই দুটো দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে নানা কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দীর্ঘদিনের শীতল যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ইরান ও সৌদি আরব একে অপরের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করছে না ঠিকই কিন্তু বলা যায় যে তারা নানা ধরনের ছায়া-যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংঘাতে তারা একেক গোষ্ঠীকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিচ্ছে। যেগুলো একটি অপরটির বিরোধী। এই সমীকরণের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে সিরিয়া। উপসাগরীয় সমুদ্রপথেও পেশীশক্তি প্রদর্শনের অভিযোগ আছে ইরানের বিরুদ্ধে। কেননা ওই পথে সৌদি আরব তেল পাঠায় বিভিন্ন দেশে।
সম্প্রতি এরকম বেশ কয়েকটি তেলের ট্যাংকারে হামলার জন্যে ওয়াশিংটন ইরানকে দায়ী করেছে। এসব অভিযোগ অবশ্য বরাবরের মতো অস্বীকার করেছে তেহরান। সম্প্রতি ব্রিটিশ ট্যাঙ্কার আটক করা নিয়েও লন্ডন-তেহরান সম্পর্কে তিক্ততা তৈরি হয়।
সরাসরি যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা কতটুকু
ইরান ও সৌদি আরব প্রত্যক্ষভাবে বিভিন্ন যুদ্ধে লিপ্ত হলেও কখনো তারা নিজেদের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার প্রস্তুতি নেয়নি। তবে সৌদি আরবের অবকাঠামোতে হুথিদের সাম্প্রতিক বড় ধরনের হামলা তেহরান ও রিয়াদের শত্রুতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
তার সঙ্গে আছে উপসাগরীয় সমুদ্র পথে তেলবাহী জাহাজ চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিও। অনেকেই মনে করছেন, এসবের ফলে এই দেশ দুটির উত্তেজনা হয়তো এখন আরো ব্যাপক সংঘাতেও রূপ নিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র পশ্চিমা দেশগুলো অনেক দিন ধরেই ইরানকে দেখে আসছে এমন একটি দেশ হিসেবে যারা মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে। এদিকে ইরানকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্যে হুমকি মনে করে সৌদি। যুবরাজ সালমান তো ইরানের প্রভাব ঠেকাতে যেকোনো ব্যবস্থা নিতেই প্রস্তুত।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সৌদি আরব ও ইরান- এই দুটো দেশের মধ্যে যদি শেষ পর্যন্ত সরাসরি যুদ্ধ লেগে যায়, তাহলে সেটা হবে দুর্ঘটনাবশত, তাদের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা কমই। আর যদি তা হয় তাহলে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক সংঘাত তৈরি করবে যে যুদ্ধ।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
এসএ/এমকেএইচ