সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যের অ্যান্টিবায়োটিক এখন দুষ্প্রাপ্য
রাজধানীসহ সারাদেশের সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যের দামি অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ও ইনজেকশন ক্রমেই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। বছর দুয়েক আগেও রাজধানীসহ সারাদেশের সরকারি হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ), করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ), কিডনি, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগব্যাধিতে আক্রান্ত চিকিৎসাধীন রোগীদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা হতো।
কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত এক পরিপত্রের কারণে সকল সরকারি হাসপাতালে আগের তুলনায় বিনামূল্যের ওষুধ বিশেষ করে দামি অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ও ইনজেকশন সরবরাহের পরিমাণ বর্তমানে উল্লেখ্যযোগ্যহারে হ্রাস পেয়েছে। সরেজমিন অনুসন্ধান ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ সব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বছর দুয়েক আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত এক পরিপত্রে বলা হয় সরকারি ইডিসিএল কোম্পানি নিজেরাই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ইনজেকশন তৈরি করছে ফলে সরকারি বিধি অনুসারে বাইরে থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কেনার প্রয়োজন নেই।
একাধিক হাসপাতালের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানান, আগে তারা খোলা দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে দুই তিনগুন কম দামে ওষুধ ও ইনজেকশন কিনতে পারতেন। কিন্তু বর্তমানে ইডিসিএল থেকে তাদের অতিরিক্ত দামে কিনতে হচ্ছে।
তারা বলেন, হাসপাতালে দিনকে দিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ফলে চাহিদা অনুসারে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করতে গিয়ে তারা হিমশিম খাচ্ছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রচলিত নিয়মানুসারে এমএসআর (ওষুধ, গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা, ল্যাবরেটরির বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কেমিকেল রি-এজেন্ট ও অক্সিজেন) খাতে বরাদ্দকৃত মোট টাকার শতকরা ৬০ ভাগ টাকার (ইডিসিএল এবং নন-ইডিসিএল) ওষুধ কিনতে হয়। ওই শতকরা ৬০ ভাগ টাকার মধ্যে আবার শতকরা ৭০ ভাগ ওষুধ বাধ্যতামূলকভাবে ইডিসিএল থেকে কিনতে হয়।
ফলে এমএসআর বাবদ মোট বরাদ্দের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই ইডিসিএল থেকে ওষুধ কিনতে গিয়ে খরচ হয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত দামে কিনতে বাধ্য হওয়ায় সারাদেশের সরকারি হাসপাতালেই আগের তুলনায় বিনামূল্যে সরবরাহকৃত ওষুধের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রকাশিত লোকাল হেলথ বুলেটিন-২০১৫ অনুসারে রাজধানীসহ সারাদেশে (মেডিকেল কলেজ, বিশেষায়িত, জেলা সদর,উপজেলা) মোট সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৫৯২টি।
দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের মধ্যে রাজধানীতে ২৩’শ শয্যার ঢামেক হাসপাতাল অন্যতম বৃহৎ হাসপাতাল। জানা গেছে, শুধুমাত্র সরকারি ঢামেক হাসপাতালেই বছরে বহিঃবিভাগে ৮লাখ ৭ হাজার ৫৮ জন, জরুরি বিভাগে ৩ লাখ ২৩ হাজার ৭৮০জন ও ভর্তি হন ১লাখ ৩৮ হাজার ৬শ’ ৫৬ জন। বছরে মৃত্যু হয় ১৩ হাজার ৫শ’ জন রোগী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢামেক হাসপাতালে এমএসআর খাতে বরাদ্দ ৩৭ কোটি টাকা। তন্মধ্যে ২২ কোটি ২০লাখ টাকা মেডিসিন এবং বাকি টাকা গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা, কেমিক্যাল রিএজেন্ট ও অক্সিজেন বাবদ বরাদ্দ রয়েছে। মেডিসিনের মোট টাকার মধ্যে ১৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা ইডিসিএলকে ওষুধের মূল্য বাবদ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
সম্প্রতি শিশু সার্জারি বিভাগে মাগুরায় গুলিবিদ্ধ শিশুটির ফুফু জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছিলেন, হাসপাতালে ভর্তির পর প্রথম দুইদিন তাদেরকে দামি অ্যান্টিবায়োটিক বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনে আনতে হয়েছে। পরে হাসপাতালের পরিচালক উদ্যোগ নিয়ে সব হাসপাতাল থেকে সরবরাহের ব্যবস্থা করেন বলে জানান তিনি।
একাধিক সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা জাগো নিউজকে জানান- আইসিইউ, সিসিইউ, জরুরি বিভাগ, নিউরোসার্জারি, কিডনি, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিগত সময়ের মতো বর্তমানে রোগীদের দামি অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিতে পারছেন না।
ফলে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বিশেষ করে মুমূর্ষু ও দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। অপ্রতুল সরবরাহের কারণে নিরুপায় হয়ে রোগীদের বাইরের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে আনার পরামর্শ দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
ঢামেক হাসপাতালের এসএলপিপি (সিনিয়র লেকচারার অব প্রাকটিক্যাল ফার্মাকোলজি) ডা. মসিউর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাসপাতালে রোগীর চাপ ক্রমশই বাড়ছে। ফলে অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন/ট্যাবলেটসহ সব ধরনের ওষুধের চাহিদা বেড়েছে।
ইডিসিএল থেকে বেশি দামে ওষুধ কেনার ফলে ওষুধ সরবরাহের পরিমাণ কমে যাওয়ায় বিনামূল্যে নিয়মিত ওষুধ দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে তিনি বলেন, যে হয়তো রোগীরা আগের চেয়ে কিছুটা ওষুধ কম পাচ্ছে, কিন্তু অধিকাংশ রোগীই পাচ্ছেনা এমনটা ঠিক নয়।
হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. নাজিমুননেছা জানান, ইডিসিএল কর্তৃক অতিরিক্ত দামে ওষুধ বিক্রির বিষয়টি জানিয়ে তারা চলতি অর্থবছরে খোলা দরপত্রের মাধ্যমে চাহিদা অনুসারে ওষুধ ক্রয়ের জন্য হাসপাতাল পরিচালকের মাধ্যমে অনুমতি চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিবেন বলে জানান।
সম্প্রতি এ প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে ঢামেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) ডা. নাজিমুননেছার কক্ষে আসেন হেমাটোলজি বিভাগীয় প্রধান এবং বোন মেরো ট্রান্সপ্লানটেশন (বিএমটি) ইউনিট কর্মসূচির পরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ খান।
তিনি ডা. নাজিমুননেছাকে বলেন, ‘গত এক বছরে সাফল্যের সাথে ১৫ জন রোগীর বোন মেরো প্রতিস্থাপন করলাম, অথচ বর্তমানে প্রয়োজনীয় ওষুধের অধিকাংশের সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।’
এ সময় ডা. নাজিমুননেছা ও সেখানে উপস্থিত এসএলপিপি ডা. মসিউর রহমান তাকে এ ব্যাপারে মন্ত্রী ও সচিবের সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়ে বলেন, আগের তুলনায় দুই তিনগুন বেশি দামে ওষুধ কিনতে বাধ্য হলেও ওষুধ বাবদ অর্থ বরাদ্দ আগের মতোই রয়ে গেছে।
ফলে ওই টাকা দিয়ে সমপরিমাণ ওষুধ কেনা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে তারা সাধারণ ওয়ার্ডেই আগের মতো অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন ও অন্যান্য ওষুধ সরবরাহ করতে পারছেন না। আর বোন মেরো ট্রান্সপ্লানটেশন এর ওষুধ তো সব অনেক দামি, তাই তাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয় বলে জানান।
এমইউ/এসকেডি/এসএইচএস/এমএস