ব্রিটেনে আগাম নির্বাচনের আরো এক প্রস্তাব নাকচ
ব্রিটিশ পালার্মেন্টের এমপিরা আরো একবার প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের আগাম নির্বাচনের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন।এরইমধ্যে আজ থেকে শুরু হতে যাচ্ছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ৫ সপ্তাহের জন্য স্থগিত কার্যক্রম।
২৯৩ জন এমপি প্রধানমন্ত্রীর আনা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছেন যা প্রয়োজনীয় ভোটের সংখ্যার তুলনায় অনেক কম।
এর আগে বিরোধী এমপিরা নিশ্চিত করেন যে, ১৫ অক্টোবর আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আনা প্রস্তাবে সমর্থন দেবেন না তারা। বরঞ্চ তারা ‘চুক্তিহীন ব্রেক্সিট’ বন্ধে একটি আইন পাসের ওপর জোর দিচ্ছেন।
বরিস জনসন এটি অবজ্ঞা করলে তার বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেয়ারও হুঁশিয়ারি দেন এমপিরা।
ব্রিটিশ মন্ত্রীরা এই আইনকে ‘যাচ্ছেতাই’ আখ্যা দিয়ে এটি রুখতে তারা তাদের চূড়ান্ত সীমা পর্যন্ত চেষ্টা করার কথা জানান।
যুক্তরাজ্যের আইন অনুযায়ী, ব্রাসেলসের সাথে চুক্তি হোক আর নাই হোক, ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করার কথা রয়েছে।
কিন্তু সোমবার রাজকীয় সম্মতি পাওয়া নতুন আইন অনুযায়ী, ১৯ অক্টোবরের মধ্যে এমপিরা চুক্তিসমেত অথবা চুক্তিহীন ব্রেক্সিটে সম্মতি না দিলে প্রধানমন্ত্রীকে ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি ব্রেক্সিট পেছানোর জন্য সময় চাইতে হবে।
বিবিসির রাজনীতি বিষয়ক সম্পাদক লরা কুয়েন্সবার্গ বলেন, যদিও ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট বলেছে যে, তারা নতুন আইনের অবাধ্য হবে না কিন্তু তারা এটিকে পাশ কাটানোর কোন উপায় আছে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পার্লামেন্ট বন্ধ থাকার সময়টিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছানোর কাজে ব্যবহার করবে সরকার। একই সঙ্গে চুক্তি ছাড়া ইইউ ত্যাগের বিষয়েও প্রস্তুতি নেয়া হবে।
তিনি বলেন, এই পার্লামেন্ট আমার হাত বেঁধে দেয়ার জন্য যত চেষ্টাই করুক না কেন, জাতির স্বার্থে আমি একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।
বরিস জনসন পার্লামেন্টে এমপিদের বলেন যে, এর আগে করবিন বলেছিলেন, ৩১ অক্টোবরের মধ্যে চুক্তিহীন ব্রেক্সিট কার্যকরে বাধ্যবাধকতার বিপক্ষে আইন হলে আগাম নির্বাচনের পক্ষে সমর্থন দেবেন তিনি।
পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সে আনা জনসনের এটি ষষ্ঠ প্রস্তাব যেটি এমপিদের ভোটে বাতিল হয়ে গেলো।
করবিন এমপিদের বলেন, লেবার পার্টি নির্বাচনে আগ্রহী ছিল- কিন্তু আমরা এটাও জানি যে, চুক্তিহীন ব্রেক্সিট কার্যকর করে আমরা আমাদের সম্প্রদায়ের জন্য চাকরি, সেবা কিংবা অধিকারগুলোকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে চাই না।
আর তিনি এটাও বলেন যে, নিজের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সমালোচনা বন্ধ করতেই পার্লামেন্ট স্থগিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
লেবার, এসএনপি, লিবারেল ডেসোক্রেটস, গ্রিন পার্টি, ইন্ডিপেনডেন্ট গ্রুপ ফর চেঞ্জ এবং প্লাইড কিমরু সোমবার সকালে বৈঠক করে একমত হয় যে তারা নির্বাচনের পক্ষে সমর্থন দেবেন না।
বিবিসির লরা কুয়েন্সবার্গ বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজের দেয়া ব্রেক্সিট কার্যকরের সময়সীমা কিছু দিন আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি কঠিন বলে মনে হচ্ছে।
তাহলে কি এটা অসম্ভব? মোটেই নয়।
কোনো একটি চুক্তিতে পৌঁছানো এখনো সম্ভব। ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট বলছে, এটি এখনো তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য।
নর্দান আয়ারল্যান্ড নিয়ে গুঞ্জন এখনো একটি পিছুটান হিসেবে রয়ে গেছে।
তবে ব্রেক্সিট কার্যকরের আশায় আজ রাতে অনেক এমপিরাই খোশ মেজাজে রয়েছেন।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, চুক্তিতে পৌঁছানোর ক্ষীণ একটি সম্ভাবনা এখনো রয়েছে।
এদিকে কমন্সের স্পিকার জন বারকো বলেছেন যে, নির্বাচন কিংবা ৩১ অক্টোবর যেটিই আগে আসুক না কেন, সেসময়ে তিনি স্পিকার এবং এমপি হিসেবে তার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াবেন। গত ১০ বছর ধরে এই দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
এর আগে সোমবার, পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্সে আরো একটি পরাজয়ের মুখে পড়েন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী।
পার্লামেন্ট স্থগিত বিষয়ে সরকারি যোগাযোগ এবং চুক্তিহীন প্রস্থান পরিকল্পনার বিষয়ে গত ২৩ জুলাই থেকে বিভিন্ন নথি প্রকাশের পক্ষে আনা এক প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছেন এমপিরা। ৩১১টি ভোটের মধ্যে ৩০২টি ভোটই প্রস্তাবের পক্ষে পড়ে।
সাবেক কনজারভেটিভ সদস্য ডমিনিক গ্রিভ, বর্তমানে স্বতন্ত্র এই এমপি যিনি এই প্রস্তাব আনেন, তিনি বলেন, নথি প্রকাশ খুবই জরুরি ছিল কারণ এর মধ্য দিয়েই হাউজ এর ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে পারবে এবং এর ফলে জনগণের সাথেও যোগাযোগ করতে সুবিধা হবে।
কিন্তু মন্ত্রী মাইকেল গভ, যিনি চুক্তিহীন ব্রেক্সিট প্রস্তুতির প্রধান হিসেবে কাজ করছেন তিনি বলেন, এরইমধ্যে তিনি ইইউ সিলেক্ট কমিটিকে ইয়োলোহ্যামার বা চুক্তিহীন-ব্রেক্সিট পরিকল্পনা সম্পর্কে জানিয়েছেন এবং তাদের সম্মতিই এ বিষয়ে যথেষ্ট বলে তিনি মনে করেন।
ইয়োলোহ্যামার বিষয়ে ইইউ এর সিলেক্ট কমিটিকে প্রমাণ দেয়ার কথা জানান মাইকেল গভ অ্যাটর্নি জেনারেল জেওফ্রে কক্স এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ডমিনিক কামিংস-সহ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ইমেইল অ্যাকাউন্ট এবং মোবাইল সম্পর্কে প্রকাশ করতে সরকারি নির্দেশের আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
ভোটের পর সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, প্রকাশ করার এই দাবিটি ‘অভূতপূর্ব এবং অপ্রয়োজনীয়’। তিনি আরো বলেন, ‘যথাসময়ে এটির প্রভাব এবং প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে।’
এছাড়া লেবার নেতা জেরেমি করবিনের আনা একটি প্রস্তাব যেখানে সরকারকে আইনের শাসন মেনে চলার আহ্বান জানানো হয় সেটিও অনানুষ্ঠানিক ভোটে পাস হয়।
তিনি বলেন যে, ব্রেক্সিট নিয়ে বর্ধিত যেসব আইন রয়েছে তা না মানার প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব আইনের শাসনের প্রতি হুমকি।
প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক রাব বলেন, সরকার সব সময়ই আইনের শাসন সমুন্নত রাখবে। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা ‘ত্রুটিপূর্ণ’ এবং যুক্তরাজ্য ৩১ অক্টোবর ইইউ ত্যাগে করার বিষয়ে যথাযথভাবেই সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে যাবে।
১৪ অক্টোবর পর্যন্ত পার্লামেন্টের স্থগিতাদেশ সোমবারের পর থেকে কার্যকর হবে।
তার মানে হচ্ছে, এই সময়ে মধ্যে এমপিরা নির্বাচন নিয়ে ভোট দেয়ার আর কোনো সুযোগ পাবেন না। অর্থাৎ সবচেয়ে দ্রুত সময়ে মধ্যে হলেও আগামী নভেম্বরের আগে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না।
অন্যদিকে, ব্রেক্সিট বিলম্ব বিষয়ে একটি পরিকল্পনা নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে। আর তা হলো- ইইউ এর কোনো সদস্য এর মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে ভেটো দেয় কিনা তার উপর।
আরেকটি উপায় হতে পারে যে, নতুন আইন অনুযায়ী ইইউকে মেয়াদ বাড়ানোর একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠানো এবং সাথে আরেকটি চিঠি পাঠানো যাতে বলা হবে যে, যুক্তরাজ্য আর দেরি করতে চায় না।
তবে, যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারক লর্ড সাম্পশন বলেন, এ ধরনের পরিকল্পনা বৈধ নয়। চিঠি পাঠিয়ে তা আবার বাতিল করার চেষ্টা আমার কাছে পরিষ্কারভাবেই আইনের লঙ্ঘন বলে মনে হয়।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জনসন সোমবার সকালে প্রথমবারের মতো তিনি আইরিশ প্রধানমন্ত্রী লিও ভারাদকারের সাথে ডাবলিনে সাক্ষাৎ করেছেন।
যুক্তরাজ্য ও ইইউএর মধ্যে ব্রেক্সিট চুক্তির একটি অন্যতম বিষয় হচ্ছে আয়ারল্যান্ডের সীমান্ত।
জনসন আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে সীমান্তে কঠোরতার বিপরীতে বীমা নীতির প্রত্যাহার চান। কারণ এটি কার্যকর হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে একক শুল্ক অঞ্চলের অধিভুক্ত হবে যুক্তরাজ্য এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতে এটি ইইউ বাণিজ্য প্রতিযোগিতার বিধিমালার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
ইইউ এর একক বাজার ব্যবস্থার সাথেও যুক্ত থাকবে নর্দান আয়ারল্যান্ড।
ইইউ এবং ইউকের যৌথ সম্মতির ভিত্তিতে এসব বিধিমালা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত এগুলো কার্যকর থাকবে।
এক সংবাদ সম্মেলনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে একটি চুক্তি হতে পারে এবং ব্যাক-স্টপের বিকল্প খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
তিনি বলেন, চুক্তি ছাড়া ইইউ ত্যাগের সিদ্ধান্ত যাতে রাজি ছিলেন, তা হবে এক ধরনের ব্যর্থতা যার জন্য সবাই দায়ী থাকবে।
ভারাদকার বলেন, ব্যাকস্টপের ‘বিকল্পতে রাজি’ আয়ারল্যান্ড। তবে তা হবে অবশ্যই বাস্তবতার সাতে সঙ্গতিপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো কোনো প্রস্তাব পাইনি।’
ব্যাকস্টপের যেকোনো বিকল্প যা শুধু নর্দান আয়ারল্যান্ডের সাথেই কার্যকর হবে তাতে রাজি তিনি।
তবে পার্লামেন্টে বরিস জনসনের মিত্র ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টির এমপিরা বলেছেন, তারা এই পরিকল্পনার দৃঢ় প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
এসএইচএস/এমকেএইচ