শত্রুর বন্দুকের মুখে তিন দশক, এনআরসি জানাল তিনি ‘বিদেশি’
তিন দশক ধরে দেশের সীমান্ত পাহারা দিচ্ছেন। প্রায়ই মুখোমুখি হন শত্রুর বন্দুকের নলের। পুরস্কার হিসেবে ভারতের প্রতীক্ষিত জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) তালিকায় তিনি এখন ‘বিদেশি’ বলে বিবেচিত হচ্ছেন।
আনন্দবাজার পত্রিকায় এমন একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বিএসএফ অফিসার মুজিবর রহমানকে এনআরসি’র তালিকায় ‘বিদেশি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। চিহ্নিত হয়েছেন ‘সন্দেহজনক ভোটার’ হিসেবেও। ভারতের মাটিতে জমিজমা-বসবাস হলেও ওই অফিসারের মতো একই তকমা লেগেছে তার স্ত্রীর ক্ষেত্রেও। দুজনের মাথায় এখন ঝুলছে গ্রেফতারি পরোয়ানা।
আসামের গোলাঘাটের বাসিন্দা মুজিবর রহমান। মাস দুয়েক আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে প্রাক্তন এক সেনাকর্মীর সঙ্গে। তবে সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী মুজিবর হাল ছাড়তে নারাজ। ‘বিদেশি’ তকমা মুছে ফেলতে শুরু করেছেন লড়াই। ইতোমধ্যে দ্বারস্থ হয়েছেন গৌহাটি হাইকোর্টে।
গত জুলাইয়ের শেষে ছুটি কাটিয়ে নিজের বাড়ি ফিরতেই খবরটা পান মুজিবুর। ফের এনআরসি অফিসে যেতে হবে। পরিবারের সকলের নথিপত্র আরও একবার খতিয়ে দেখা হবে। সেসব মিটে যাওয়ার পর গত ৫ অগস্ট জানতে পারেন, তিনি ও তাঁর স্ত্রী এ দেশের নাগরিক নন।
ছেলে-বৌমা ‘বিদেশি’ শুনে মুজিবুরের ৮৮ বছরের বৃদ্ধ বাবা বাপধন আলি বলেন, ‘তিন দশক ধরে দেশের সেবা করছে আমার ছেলে। বিএসএফের অ্যাসিস্টান্ট সাব-ইন্সপেক্টর। সীমান্ত পাহারা দেয়। সে বিদেশি হয় কী করে? ১৯৫০ থেকে এ দেশে জমি কেনার নথিপত্র রয়েছে। আমরা ভারতীয় হলে বিদেশি হলাম কীভাবে?’
তবে বাপধন আলির মুখের কথা এনআরসি কর্তৃপক্ষের মন গলেনি। সমস্ত নথিপত্র খতিয়ে দেখার পর তাদের রায়, মুজিবুর ও তার স্ত্রী এ দেশের বাসিন্দা নন। নির্বাচন কমিশনের খাতায় তারা ‘সন্দেহজনক ভোটার’। গোটা বিষয়টি তারা জানিয়েছেন যোরহাটের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে। সেই ট্রাইব্যুনাল মুজিবুর রহমান ও তার স্ত্রীকে ‘বিদেশি’ হিসাবে চিহ্নিত করে। এরপর মুজিবুর ও তার স্ত্রীকে গ্রেফতার করতে হবে বলে আসাম পুলিশকে নির্দেশ দেয় ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল। যা নিয়ে আদালতে দ্বারস্থ হয়েছেন ১৪৪ ব্যাটালিয়নের সঙ্গে পঞ্জাবে কর্মরত মুজিবুর। ফলে আপাতত আদালতের রায়ের অপেক্ষায় পুলিশও।
গোলাঘাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুরজিৎ সিংহ পানেসর বলেন, ‘মুজিবুরের বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন। ফলে আমরা সেই রায়ের জন্য অপেক্ষা করব।’
অপেক্ষায় রয়েছেন মুজিবুরের বৃদ্ধ বাবাও। এনআরসির তালিকায় নিজের আর পাঁচ ছেলে-মেয়ে জায়গা পেলেও মুজিবুর কেন যে তাতে ঠাঁই পেলেন না, সে উত্তরই খুঁজছেন বৃদ্ধ!
সম্প্রতি কাশ্মীর ইস্যুতে উত্তপ্ত ভারত। গত ৫ আগস্ট কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সংক্রান্ত সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে মোদি সরকার। ফলে কাশ্মীর এখন কেন্দ্র সরকারের সম্পূর্ণ ও সরাসরি নিয়ন্ত্রণে। সরকারের এমন উদ্যোগের প্রতিবাদে কাশ্মীরে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে প্রতিনিয়ত সাধারণ কাশ্মীরিরা সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন। শুধু কাশ্মীর নয় সীমান্তে যুদ্ধাংদেহী পরিস্থিতি বিরাজ করছে পারমাণবিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ দু’দেশ ভারত-পাকিস্তান।
অন্যদিকে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম থেকে অবৈধ নাগরিকদের তাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে ভারত সরকার। সেখানে ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনের (এনআরসি) তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। চূড়ান্ত তালিকা আগামী ৩১ আগস্ট প্রকাশিত হবে বলে জানা গেছে।
এর আগে আসাম থেকে অবৈধ বাঙালিদের বের করে দেয়ার হুমকি দেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। যদিও সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর বলেন, আসামে এনআরসি নিয়ে যা হচ্ছে সেটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
২০ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনকে সঙ্গে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ‘আসামে যে ৪০ লাখ মানুষ নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে আছে সেটি বাংলাদেশকে প্রভাবিত করবে কি-না’- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে কথা বলার কিছু নেই।’
এমএআর/এমকেএইচ