কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তান যা যা করতে পারে
কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারকে লক্ষ্য করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একের পর তীব্র আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। মোদি সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সঙ্গে হিটলার এবং নাৎসিদের তুলনা করছেন তিনি।
টুইট বার্তায় ইমরান খান লিখেছেন, ‘কারফিউ, কঠোর বিধিনিষেধ এবং ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে আসন্ন গণহত্যা আরএসএস-এর (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) আদর্শ। যে আদর্শ নাৎসিদের আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত। জাতিগত নিধনের মাধ্যমে কাশ্মীরের জনসংখ্যার অনুপাত বদলের চেষ্টা চলছে।’
পাক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রশ্ন হচ্ছে, মিউনিখে হিটলারকে যেভাবে তোষণ করা হয়েছিল, বিশ্ব কী এবারও তেমনই ভূমিকা নেবে?’ তার আগে আরেকটি টুইটে ইমরান খান লেখেন, ‘আরএসএস-এর হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদের আদর্শ নিয়ে আমি শঙ্কিত, কারণ এটা নাৎসিদের আদর্শের মতো।’
ইমারান খান হুমকি দিয়ে বলেন, ‘ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এই আদর্শ প্রতিহত করতে হবে। আর তা যদি করা না যায় তাহলে ভারতে মুসলিম নির্যাতন বাড়বে। তারা একসময় পাকিস্তানকেও লক্ষ্যবস্তু বানাবে। হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদ হিটলার-শাহিরই একটি সংস্করণ।’ প্রসঙ্গত, আরএসএস ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির মূল আদর্শিক সংগঠন।
The curfew, crackdown & impending genocide of Kashmiris in IOK is unfolding exactly acc to RSS ideology inspired by Nazi ideology. Attempt is to change demography of Kashmir through ethnic cleansing. Question is: Will the world watch & appease as they did Hitler at Munich?
— Imran Khan (@ImranKhanPTI) August 11, 2019
বোঝাই যাচ্ছে, ভারতের সরকারি দল বিজেপির সঙ্গে হিটলার এবং নাৎসিবাদের তুলনা করে পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান কাশ্মীরের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। বছরখানেক আগে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে কাশ্মীর নিয়ে সঙ্কটের মধ্যে রয়েছেন ইমরান খান।
গত ফেব্রুয়ারিতে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় একটি সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ প্রায় বেধে গিয়েছিল। তার কিছুদিন না যেতেই কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বিলোপের ভারতের এই অকস্মাৎ সিদ্ধান্তের প্রচণ্ড এক ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে তাকে।
বৈশ্বিক গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য থেকে এটা কম-বেশি স্পষ্ট যে, মোদি সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন অবসান করায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল পাকিস্তান।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেহমুদ কোরেশি ওইদিনই জিও টিভিতে এক সাক্ষাতকারে কার্যত স্বীকার করেন, ভারতের এই পদক্ষেপে তিনি হোঁচট খেয়েছেন। পরপরই পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে একের এক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করে।
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দফায় দফায় মন্ত্রী এবং সেনা কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলছেন। ভারতীয় হাইকমিশনারকে বহিষ্কার করা হয়েছে। একইসাথে দিল্লিতে তাদের রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে এনেছে। সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিত করেছে।ুু
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ওইদিনই এক বিবৃতিতে বলা হয়, কাশ্মীরের মানুষের প্রতি দায়বোধ পালনে তারা যে কোনো পথ নিতে প্রস্তুত। কিন্তু কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের সাথে আরেকটি যুদ্ধের মতো চরম কোনো পথে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটা পাকিস্তানের?
পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মহল থেকে এখন পর্যন্ত যুদ্ধের সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়া হচ্ছে। সামরিক পথে যাওয়ার সম্ভাবনা পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছেন জাতিসংঘে পাকিস্তানের দূত মালিহা লোধী।
শুক্রবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে তিনি বলেন, কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক পথে এগোনোর বহু রাস্তা পাকিস্তানের সামনে খোলা এবং সেই পথেই তারা এগোবে।
দক্ষিণ এশিয়া নিরাপত্তা বিষয়ের বিশ্লেষক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বিবিসিকে বলেন, কাশ্মীরের সর্ব-সাম্প্রতিক এই ইস্যুটিকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে যাওয়া ছাড়া পাকিস্তানের সামনে এখন তেমন কোনো বিকল্প নেই।
তিনি আরও বলেন, ‘জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের তিনটি প্রস্তাব রয়েছে। ভারতের সিদ্ধান্তে ওই সব প্রস্তাব অকার্যকর হয়ে যায়নি। জাতিসংঘ এবং একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যেতে হবে পাকিস্তানকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের কতটা গুরুত্ব দিতে পারে?
ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য উন্মুখ। তাই তারা তালেবানের সঙ্গে বিষয়টর সুরাহা করতে শান্তি আলোচনা অব্যাহত রেখেছে। এই প্রচেষ্টায় সাফল্যের জন্য ইসলামাবাদের সহযোগিতা ওয়াশিংটনের কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ।
ড. আলী বলেন, ‘ইমরান খান এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে ব্যক্তিগত বোঝাপড়া ভালো। পাকিস্তান হয়তো সেটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। ট্রাম্প ও ইমরানের সম্পর্ক বহুদিনের ২৫ বছর ধরে তারা পরস্পরকে চেনেন, যোগাযোগ আছে।’
পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক দি ডেইল টাইমস এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো জোট যদি জাতিসংঘ প্রস্তাব মেনে চলার জন্য ভারতের ওপর চাপ তৈরি না করে, তাহলে পাকিস্তানের উচিৎ আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সাহায্য বন্ধ করে দেয়া।
আফগানিস্তান-ভারতের বাণিজ্য পথ এবং পাকিস্তানের আকাশ ভারতের জন্য বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করছেন পাকিস্তানের কেউ কেউ। চীনের ওপরও চাপ তৈরির কথা লিখেছে ডেইলি টাইমস।
তারা বলছে, ‘চীন যদি চায় চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর বা সিপিইসি নিরবিচ্ছিনভাবে চলুক, তাহলে চীনকে পাকিস্তানের সঙ্গে কাঁধ মেলাতে হবে।’
পাকিস্তানের সাবেক একজন কূটনীতিক এবং সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শামসাদ আহমেদ বিবিসিকে বলেছেন, সরকারের উচিৎ প্রভাবশালী দেশেগুলোকে এটা জানান দেয়া যে, ভারতের এই পদক্ষেপের ফলে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের কত বড় হুমকি তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন কাশ্মীর প্রসঙ্গে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব করলেন তার পরপরই ভারত কাশ্মীরে এই কাণ্ড করলো। এখানে পাকিস্তানের কোনো ভূমিকা নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে পাকিস্তানকে এই বিষয়টিকেই বোঝাতে হবে।’
পাকিস্তানের আরেক সাবেক পররাষ্ট্র সচিব নাজমুদ্দিন শেখ বলেন, আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়াকে কাজে লাগাতে পারে পাকিস্তান, তবে কোনো ভাবেই পাকিস্তানের উচিৎ হবেনা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিষয়টিকে শর্ত হিসাবে তুলে ধরা।
তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের এখন উচিৎ হবে যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্রদের কাছে বলা যে, আঞ্চলিক শান্তি এবং স্থিতিশীলতার স্বার্থে পাকিস্তান এবং ভারতের সংঘাতের সমাধান হওয়া প্রয়োজন।। কিন্তু আফগান শান্তি প্রক্রিয়া নষ্ট করে দেয়ার চেষ্টা করা একবারেই ঠিক হবেনা।’
কাশ্মীরে বিদ্রোহে অস্ত্র বা অন্য কোনো উপায়ে সরাসরি মাথা গলানোর কোনো চেষ্টা থেকেও পাকিস্তানের বিরত থাকা উচিৎ বলেও মনে করেন নাজিমুদ্দিন শেখ।
তার মতে, ‘ভারত সবসময় দেখাতে চায় পাকিস্তান কাশ্মীর পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তারাই সশস্ত্র সন্ত্রাসীদে মদদ দেয় কাশ্মীরে। সুতরাং এখন এমন কিছু করা পাকিস্তানের জন্য ঠিক হবেনা যাতে ভারত কোনো অজুহাত পেতে পারে।’
সূত্রের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত পাকিস্তান সেই পথেই যাচ্ছে। ইমরান খানের সাম্প্রতিক বক্তব্য এবং টুইটগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, তিনি কাশ্মীরের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার পথই নিচ্ছেন।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মোহাম্মদ কোরেশি জেদ্দায় গিয়ে ইসলামি ঐক্য সংস্থা বা ওআইসির কাছে গিয়ে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন। শুক্রবার তিনি চীনে গেছেন।
চীন কতটুকু এগুতে পারে সে বিষয়টিও বেশ গুরুত্ব বহন করে। গত শুক্রবার বেইজিংয়ে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আড়াই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বৈঠক হয়েছে। পরে পাকিস্তানের মন্ত্রী বলেন, কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানের সঙ্গে রয়েছে চীন।
লাদাখের কিছু কিছু এলাকার মালিকানা দাবি করে চীন, ফলে ইতোমধ্যেই তারা লাদাখকে ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বিবৃতি দিয়েছে। চীনা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতের এই পদক্ষেপ তাদের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি।
তবে জিনজিয়াং প্রদেশে মুসলিমদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে চীন। ফলে কাশ্মীরিদের ব্যাপারে তারা পাকিস্তানকে কতটা জোরালো সমর্থন জোগাবে, তা নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞেরই সন্দেহ রয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের অন্য স্থায়ী সদস্যদের পক্ষ থেকেও ভারতের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
এসএ/এমএস